আল-লাতীফ (সূক্ষ্মদর্শী, অমায়িক)[1]

আল্লাহর নামসমূহের মধ্যে আরেকটি নাম হলো আল-লাতীফ তথা সূক্ষ্মদর্শী, অমায়িক। যিনি তাঁর ইলমে অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী; এমনকি ক্ষুদ্র থেকে অতি ক্ষুদ্রতর ও লুকায়িত জিনিস সম্পর্কেও অবগত। মানুষের অন্তরে যা কিছু রয়েছে, জমিনের অভ্যন্তরে যে সব শস্য-দানা লুকায়িত রয়েছে সব কিছু সম্পর্কে তিনি জানেন। তিনি তাঁর প্রিয় ও নির্বাচিত বান্দাদের সাথে অমায়িক ও দয়ালু ব্যবহার করে থাকেন। ফলে তাদেরকে তিনি সহজ পথ দেখান এবং কঠোরতা থেকে দূরে রাখেন। তাঁর সন্তুষ্টি ও দয়া পেতে তিনি তাদের জন্য সমস্ত পথ সহজ করে দেন এবং তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে থাকতে যেসব পথ তারা জানে ও যা তারা জানে না সব ধরণের পথ থেকে তিনি তাদেরকে সংরক্ষণ করেন। তাঁর ভালোবাসা পেতে কষ্টকর কাজ করতে তারা যা অপছন্দ করেন তিনি তাদেরকে সে কাজগুলো করতে সক্ষমতা দান করেন। ফলে তিনি তাদেরকে দয়া করেন, তাদেরকে সুন্দর পরিণাম ও উত্তম পুরস্কার দান করেন। যে কাজে তাদের জন্য কল্যাণ, সংশোধন ও সফলতা রয়েছে সেগুলো তাদের সক্ষমতার বাহিরে থাকলেও তিনি তাদেরকে সাহায্য করে দয়া করেন। অত;এব, আল-লাতীফের সমর্থক অর্থ হলো আল-খাবীর (সম্যক অবগত, সর্বজ্ঞ), আর-রাঊফ (অত্যন্ত স্নেহশীল, সদয়, সমবেদনা প্রকাশকারী, দয়াশীল) ও আল-কারীম (মহা সম্মানিত, মহা দয়ালু)।[2]

তাঁর বান্দা ও অলীর প্রতি তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ যে, তিনি যাকে তাঁর ইহসান পূর্ণ করতে চান, তাঁর দয়ায় যাকে শামিল করতে চান এবং তাকে সর্বোচ্চ সুমাহান স্থান তথা জান্নাতে পৌঁছাতে চান তাকে তিনি চলার পথ সহজ করে দেন, কঠিন পথ থেকে তাকে দূরে রাখেন, তার অপছন্দনীয় নানা ধরণের পরীক্ষায় ফেলে কষ্ট দেন; যদিও তার জন্য এতে রয়েছে কল্যাণ, সৌভাগ্যের পথ, যেমনিভাবে তিনি আম্বিয়াদেরকে তাদের জাতির দ্বারা ও তাঁর পথে জিহাদের মাধ্যমে নানা কষ্ট দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ ইউসূফ আলাইহিস সালামের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর অনুগ্রহে কীভাবে তাঁর অবস্থা উন্নতি হয়েছিল। আল্লাহ তার জন্য যে অবস্থা নির্ধারিত করেছিলেন তাতে ছিল তার দুনিয়া ও আখিরাতের উত্তম পরিণতি। এমনিভাবে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাহদেরকে তাদের অপছন্দনীয় জিনিস দ্বারা পরীক্ষা করেন, যাতে তারা তাদের পছন্দনীয় জিনিস অর্জন করে। বান্দার উপর আল্লাহর কত অনুগ্রহ ও দয়া রয়েছে যা বিবেক বুঝতেও পারে না এবং কল্পনা শক্তিও তা কল্পনা করতে পারে না। কত বান্দা দুনিয়ার কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব বা অন্য কোন প্রিয় জিনিস অর্জনের চেষ্টা করে; কিন্তু আল্লাহ তার উপর রহমত করে সে জিনিস থেকে তাকে দূরে রাখেন যাতে তা তার দীনের ব্যাপারে ক্ষতি করতে না পারে। ফলে বান্দা অজ্ঞতা ও তার রবের সম্পর্কে না জানার কারণে চিন্তিত হয়ে পড়ে। কিন্তু গায়েবে আল্লাহ তার জন্য কী গচ্ছিত করে রেখেছেন সে যদি তা জানত তাহলে অবশ্যই সে এ ব্যাপারে আল্লাহ হামদ ও শুকর আদায় করত। কেননা আল্লাহ তাঁর বান্দার ব্যাপারে অত্যন্ত স্নেহশীল ও দয়ালু এবং তাঁর অলীদের ব্যাপারে অত্যন্ত অনুগ্রহশীল।

হাদীসে দো‘আয় এসেছে,

«اللَّهُمَّ ارْزُقْنِي حُبَّكَ وَحُبَّ مَنْ يَنْفَعُنِي حُبُّهُ عِنْدَكَ، اللَّهُمَّ مَا رَزَقْتَنِي مِمَّا أُحِبُّ فَاجْعَلْهُ قُوَّةً لِي فِيمَا تُحِبُّ، اللَّهُمَّ وَمَا زَوَيْتَ عَنِّي مِمَّا أُحِبُّ فَاجْعَلْهُ فَرَاغًا لِي فِيمَا تُحِبُّ».

“হে আল্লাহ! আমাকে দান করুন আপনার ভালোবাসা এবং তাদের ভালোবাসা যাদের ভালোবাসা আমার উপকারে আসবে যা আপনার কাছে প্রিয়। হে আল্লাহ! আমি যা পছন্দ করি তার যা কিছু আপনি আমাকে দিয়েছেন, তার আপনি যা কিছু পছন্দ করেন তা আমাকে ব্যবহারের শক্তি দিন। আর আমার পছন্দনীয় যা আপনি আমার থেকে সরিয়ে রেখেছেন, এ সরিয়ে রাখাকে আপনি যা ভালোবাসেন তাতে নিয়োজিত থাকার অবকাশ স্বরূপ বানিয়ে দাও।”[3]

হে আল্লাহ আপনার ফয়সালার ব্যাপারে আমাদের উপর অনুগ্রহ করুন, আমাদের জন্য আপনার কুদরতের ব্যাপারে বরকত দান করুন, যাতে আমরা সে সব বিষয় পছন্দ না করি যা আপনি আমাদের ব্যাপারে বিলম্বে লিপিবদ্ধ করেছেন এবং আপনি যা দ্রুত লিখে রেখেছেন তা যেন আমরা বিলম্বে পছন্দ না করি।[4]

জেনে রাখুন, বান্দা তার যবানের দ্বারা ও যবানের অবস্থার দ্বারা আল্লাহর কাছে যে অনুগ্রহ প্রার্থনা করে তা হলো রহমত; বরং তাঁর বিশেষ রহমত কামনা করে। বান্দা অজানা বা উপকরণ জানা ব্যতীত যেসব রহমত প্রাপ্ত হয় তা হলো তাঁর (আল্লাহর) অনুগ্রহ ও দয়া। বান্দা যখন বলে, হে লাতীফ, আমাকে অনুগ্রহ করুন অথবা আপনার লুফত তথা অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি তখন এর অর্থ হলো, আমাকে আপনার বিশেষ হিফাযতে রক্ষণাবেক্ষণ করুন যাতে আমার বাহ্যিক ও গোপনীয় সব অবস্থা কল্যাণকর হয়, যাতে আমার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সকল ব্যাপারে অকল্যাণকর ও অপছন্দনীয় বিষয় থেকে আমাকে দূরে রাখুন। অত:এব, বান্দার অভ্যন্তরীণ ব্যাপার গুলো তার উপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ এবং বাহ্যিক বিষয়গুলোও বান্দার জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ। সুতরাং আল্লাহ যখন তাঁর বান্দার উপর সহজ করতে চান, তখন কল্যাণের পথ তার জন্য সহজ করে দেন এবং সে পথে চলতে তাকে সাহায্য করেন। তখন বলা হয় তিনি তাঁর উপর অনুগ্রহ করেছেন। আবার তিনি যখন সে পথে চলার বাহ্যিক উপকরণ নির্দিষ্ট করে দেন যা বান্দার শক্তি ও সামর্থ্যের মধ্যে তখন বুঝবে তিনি তার (বান্দার) উপর অনুগ্রহ করেছেন। এ কারণেই যখন ইউসুফ আলাহিস সালামের শৈশবের সে অবস্থা পরিবর্তন হয়েছিল, তার স্বপ্নে দেখা অবস্থা অনুসারে তার অবস্থা একে একে পরিবর্তন হতেছিল, তার ভাইয়েরা তার সাথে হিংসা করেছিল, তারা তাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা করেছিল, বাবার সাথে তাদের বাদানুবাদ, অত:পর (মিসরের) নারীদের দ্বারা তাকে পরীক্ষায় পতিত হওয়া, অত:পর জেলখানায় যাওয়া, অত:পর বাদশার স্বপ্নের ব্যাখ্যা দান করার কারণে সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া, তিনি (আল্লাহ) যেভাবে ইচ্ছা করেছেন সেভাবে তাকে জমিনের নেতৃত্ব প্রদান, তার ভাইদের সাথে যেসব পরীক্ষা ও বালা-মুসিবত সংঘটিত হয়েছিল, অত:পর পুনরায় তাদের আনন্দময় একত্রিত হওয়া, তাদের পূর্বের দু:খ-কষ্ট দূরীভূত হওয়া, সকলের সংশোধন হয়ে যাওয়া এবং ইউসুফ আলাইহিস সালামকে আল্লাহ নির্বাচিত করা ইত্যাদি ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহর নবী আলাইহিস সালাম বুঝতে পেরেছেন যে, এ সব কিছুই তার জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া। তাই তিনি আল্লাহর এ নি‘আমতের কথা স্বীকার করে বললেন,

﴿إِنَّ رَبِّي لَطِيفٞ لِّمَا يَشَآءُۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡعَلِيمُ ٱلۡحَكِيمُ١٠٠﴾ [يوسف: ٩٩]

“নিশ্চয় আমার রব যা ইচ্ছা করেন, তা বাস্তবায়নে তিনি সূক্ষ্মদর্শী। নিশ্চয় তিনি সম্যক জ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৯৯] অর্থাৎ আল্লাহর অনুগ্রহ তাঁর সেসব বান্দার জন্য খাস যাদেরকে তিনি এ অনুগ্রহ করতে ইচ্ছা করেন, আল্লাহ যাদেরকে এ অনুগ্রহের যোগ্য মনে করেন তাদেরকেই তিনি এ অনুগ্রহ দান করেন। তিনি যোগ্য পাত্র ব্যতীত তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ দান করেন না। আল্লাহই অধিক জ্ঞাত কোথায় তাঁর দয়া দান করা দরকার। যখন দেখবে আল্লাহ কোন বান্দার কাজকে সহজ করে দিয়েছেন, তার জন্য কল্যাণের পথ সহজ করে দিয়েছেন, কঠিনতাকে তার অধীনস্ত ও আয়ত্ব করে দিয়েছেন, তার জন্য তাঁর রহমতের দরজা খুলে দিয়েছেন, তার জন্য তাঁর (আল্লাহর) পথ খুলে দিয়েছেন, সে পথে চলার উপকরণ প্রস্তুত করে দিয়েছেন এবং যাবতীয় কঠোরতা ও বাঁধা দূর করে দিয়েছেন তখন বুঝবে যে, তিনি (আল্লাহ) উক্ত বান্দার উপর বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন।

মুমিন বান্দার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের নিদর্শন যে, তিনি তাঁর অনুগ্রহে তাদের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন, ফলে তাদেরকে গোমরাহীর অন্ধকার থেকে হিদায়েতের আলোতে নিয়ে এসেছেন, অজ্ঞতা, কুফুরী, বিদ‘আত ও গুনাহের অন্ধকার থেকে ইলম, ঈমা ও আনুগত্যের আলোতে নিয়ে এসেছেন। মুমিনের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ যে, তিনি তাদেরকে নফসে আম্মারার দ্বারা তাদেরকে নিজেদের স্বভাব থেকে ভালো কাজের নির্দেশ দেয় এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে নির্দেশ দেয়। ফলে তিনি তাদেরকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখেন। বান্দা নিজের মনে ফিতনার উপকরণ, গুনাহের দিকে আকর্ষণ ও অন্যায় কাজে প্রবৃত্তির লালসা অনুভব করলে আল্লাহ তাঁর দয়ায় এ সবের বিরুদ্ধে দলিল প্রেরণ করেন, তিনি তাদের অন্তরে ঈমানের নূর প্রজ্বলিত করে দেন, তিনি তাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন, ফলে বান্দা এসব খারাপ কাজ সেচ্ছায় প্রশান্তি চিত্তে ছেড়ে দেয়; কেননা তার অন্তর এগুলো ছেড়ে দিতে খুলে যায়।

বান্দার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ যে, তিনি তাদেরকে তাঁর ইলম অনুযায়ী তাদের কল্যাণে রিযিক নির্ধারণ করেন, বান্দার ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি তাদেরকে রিযিক দান করেন না। কেননা বান্দা হয়ত এমন সব জিনিস কামনা করবে; অথচ অন্যটি এর চেয়েও কল্যাণকর ও তার জন্য অধিক উপকারী। তাই আল্লাহ বান্দার জন্য যেটি বেশি উপকারী ও দরকারী সেটিই নির্ধারণ করেন; যদিও বান্দা তা অপছন্দ করেন। আর এটি বান্দার প্রতি আল্লাহ বিশেষ অনুগ্রহ, দয়া ও ইহসান। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿ ٱللَّهُ لَطِيفُۢ بِعِبَادِهِۦ يَرۡزُقُ مَن يَشَآءُۖ وَهُوَ ٱلۡقَوِيُّ ٱلۡعَزِيزُ ١٩ ﴾ [الشورى: ١٩]

“আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অতি দয়ালু। তিনি যাকে ইচ্ছা রিযিক দান করেন। আর তিনি মহাশক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ১৯]

﴿وَلَوۡ بَسَطَ ٱللَّهُ ٱلرِّزۡقَ لِعِبَادِهِۦ لَبَغَوۡاْ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَٰكِن يُنَزِّلُ بِقَدَرٖ مَّا يَشَآءُۚ إِنَّهُۥ بِعِبَادِهِۦ خَبِيرُۢ بَصِيرٞ٢٧﴾ [الشورى: ٢٧]

“আর আল্লাহ যদি তার বান্দাদের জন্য রিযিক প্রশস্ত করে দিতেন, তাহলে তারা জমিনে অবশ্যই বিদ্রোহ করত। কিন্তু তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণে যা ইচ্ছা নাযিল করেন। নিশ্চয় তিনি তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে পূর্ণ অবগত, সম্যক দ্রষ্টা।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ২৭]

আল্লাহর পরম অনুগ্রহের মধ্যে অন্যতম অনুগ্রহ হলো আল্লাহ তার বান্দাদেরকে আদেশ নিষেধের পালনের দ্বারা নানা ধরণের বালা-মুসিবত, পরীক্ষা ও কষ্ট-ক্লেশে পতিত করান, এটি তাদের প্রতি রহমত ও অনুগ্রহ স্বরূপ, তাদেরকে পূর্ণতা ও পরিপূর্ণ নি‘আমত অর্জনের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿وَعَسَىٰٓ أَن تَكۡرَهُواْ شَيۡ‍ٔٗا وَهُوَ خَيۡرٞ لَّكُمۡۖ وَعَسَىٰٓ أَن تُحِبُّواْ شَيۡ‍ٔٗا وَهُوَ شَرّٞ لَّكُمۡۚ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ وَأَنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ٢١٦﴾ [البقرة: ٢١٦]

“এবং হতে পারে কোন বিষয় তোমরা অপছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হতে পারে কোন বিষয় তোমরা পছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১৬]

বান্দার ওপর আল্লাহ অনুগ্রহ যে, তিনি তাদেরকে উচ্চ মর্যাদাবান ও উচ্চ স্থানের অধিকারী করেছেন, যা বড় কোন উপকরণ দ্বারা লাভ করা সম্ভব নয়, আর এ স্থান শুধু উচু হিম্মত ও দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারীগণ লাভ করবে। তিনি শুরু থেকেই তাদের জন্য সম্ভাব্য উপকরণ নির্ধারণ করে দেন যা তাদেরকে ধীরে ধীরে নিম্ন মর্যাদা থেকে উঁচু মর্যাদার অধিকারী করে, তারা সে মর্যাদা লাভের অনুশীলন করতে থাকে এবং সে জাতিয় মর্যাদা লাভের যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হয়। যেমনিভাবে আল্লাহ মূসা, মুহাম্মাদ ও অন্যান্য নবীদেরকে শুরুতে মেষ চড়ানো নির্ধারণ করেন যাতে তারা অবোধ পশু পালন করে ধীরে ধীরে বনী আদমের লালন পালন, তাদেরকে দাওয়াত ও সংশোধন করা ইত্যাদি শিক্ষা লাভ করতে পারেন। এমনিভাবে তিনি তাঁর কতিপয় বান্দাদেরকে কিছু কিছু ইবাদতের স্বাদ আস্বাদন করান, ফলে তারা সে ইবাদত করতে আকর্ষিত ও উৎসাহিত হয়, এরপরে তাদের এমন কিছু যোগ্যতা অর্জিত হয় যা দ্বারা তারা আরো অধিক বড় ও উত্তম ইবাদত ও আনুগত্যের কাজ করতে সক্ষম হয়। তাদের পূর্বের ইচ্ছা দ্বারা এ যোগ্যতা অর্জন হয় নি; বরং আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে তারা এ ইচ্ছাশক্তি ও পূর্ণ উৎসাহ অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

বান্দার ওপর আল্লাহর আরো অনুগ্রহ যে, তিনি বান্দার অভিভাবকত্বের জন্য সংশোধনকারী, জ্ঞানী, ঈমানদার ও কল্যাণের অধিকারী কাউকে নিয়োগ করেন যাতে সে তাদের থেকে আদব-কায়েদা শিক্ষা লাভ করতে পারে, তাদের যোগ্যতা ও সংস্কারে বেড়ে ওঠতে পারে, যেমন আল্লাহ মারইয়াম আলাইহাস সালামকে পরীক্ষা করেছিলেন। আল্লাহ বলেছেন,

﴿فَتَقَبَّلَهَا رَبُّهَا بِقَبُولٍ حَسَنٖ وَأَنۢبَتَهَا نَبَاتًا حَسَنٗا وَكَفَّلَهَا زَكَرِيَّاۖ كُلَّمَا دَخَلَ عَلَيۡهَا زَكَرِيَّا ٱلۡمِحۡرَابَ وَجَدَ عِندَهَا رِزۡقٗا٣٧﴾ [ال عمران: ٣٧]

“অতঃপর তার রব তাকে উত্তমভাবে কবুল করলেন এবং তাকে উত্তমভাবে গড়ে তুললেন। আর তাকে যাকারিয়্যার দায়িত্বে দিলেন। যখনই যাকারিয়্যা তার কাছে তার কক্ষে প্রবেশ করত, তখনই তার নিকট খাদ্যসামগ্রী পেত।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩৭] এ ঘটনার শেষ পর্যন্ত…..। এ ধরণের বিশেষ অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত হলো, কেউ সৎ পিতা-মাতার থেকে জন্ম গ্রহণ করে বেড়ে উঠা বা মুত্তাকী আত্মীয়-স্বজনের কাছে বড় হওয়া বা কল্যাণকর রাষ্ট্রে বড় হওয়া বা সৎলোকের সান্নিধ্য লাভ ও তাদের সংস্পর্শে থাকতে আল্লাহর তাওফিক লাভ করা বা আল্লাহ ওয়ালা আলেমের তারবিয়্যাতে বড় হওয়া ইত্যাদি বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ দয়া ও অনুগ্রহ। কেননা বান্দার কল্যাণ ও ভালো কাজ নির্ভর করে অনেক উপকরণের উপর, এসবের মধ্যে অন্যতম; বরং বলতে গেলে এসবে মধ্যে সর্বাধিক উত্তম ও উপকারী উপায় হচ্ছে উপরোক্ত উপায়সমূহ। আল্লাহর এ ধরণের অনুগ্রহের মধ্যে আরো অনুগ্রহ হচ্ছে, কেউ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাযহাবের এলাকায় বড় হওয়া। এটি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। এমনিভাবে আল্লাহর অনুগ্রহ যে, তিনি যদি তাকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও মুত্তাকি এমন উস্তাদের ভাগ্যবান করেন যাদের দ্বারা পৃথিবীর জীবিত ও মৃত সব ধরণের মানুষ উপকৃত হয় তাহলে তা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. কে এ উম্মাতের এ শতাব্দিতে পাওয়া, তার ও তার ছাত্রদের দ্বারা উম্মাত অনেক কল্যাণ লাভ, সুদৃঢ় ইলম অর্জন, বিদ‘আতী, শির্ক ও কুফুরীর বিরুদ্ধে জিহাদ, অত:পর তার কিতাবসমূহ সে সময় ছড়িয়ে পড়া ইত্যাদির দ্বারা যারা উপকৃত হয়েছেন তাদের জন্য এটি নিঃসন্দেহে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। এগুলো বর্তমানে বিদ্যমান থাকা অনেক কল্যাণকর। তাই সমস্ত প্রশংসা, অনুগ্রহ ও দয়া মহান আল্লাহর।

বান্দার জন্য হালাল রিযিকের ব্যবস্থা ও এতে সন্তুষ্টি থাকা মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। এতে তার জীবন নির্বাহের উদ্দেশ্য সাধিত হয়ে যায় এবং ইবাদত, ইলম ও আমল ইত্যাদি উদ্দেশ্যে তাকে যে সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে বাধা সৃষ্টি করে না; বরং হালাল রিযিক ও স্বল্পে তুষ্টি তাকে এসব কাজে সাহায্য করে, দুনিয়াবী নানা ঝামেলা থেকে তাকে মুক্ত রাখে, তার অন্তরের নানা জল্পনা-কল্পনাতে প্রশান্তি দেয় ও শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুস্থ থাকে। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ যে, বান্দা হয়ত দুনিয়াবী কোন কারণে উচ্চাকাঙ্খা পোষণ করে, সে হয়ত ভাবে এতে তার লক্ষ্য অর্জন হবে; কিন্তু আল্লাহ জানেন যে, এতে তার জন্য রয়েছে ক্ষতি ও অপকারীতা। ফলে তিনি তাকে ও সে জিনিস থেকে আড়াল করে রাখেন, তখন যদিও বান্দা অজ্ঞতা বশত কাজটি অপছন্দ করে; অথচ তার রব তার ওপর অনুগ্রহ করেছেন, যেহেতু তার জন্য অধিক উপকারী নি‘আমতটি অবশিষ্ট রয়েছে এবং আল্লাহ তার থেকে ক্ষতিকর বিষয়টি দূর করে দিয়েছেন। এ কারণেই এ ধরণের ব্যাপারে আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা সর্বোচ্চ পর্যায়ের মর্যাদা।

আল্লাহর অনুগ্রহের মধ্যে আরেকটি অনুগ্রহ যে, তিনি যখন কাউকে বড় কোন আনুগত্যের তাওফিক দান করেন- যা সাহায্যকারী ব্যতীত সফল হওয়া যায় না- তখন তিনি তাকে সাহায্যকারীও দান করেন। যেমন মূসা আলাইহিস সালাম বলেছিলেন,

﴿وَٱجۡعَل لِّي وَزِيرٗا مِّنۡ أَهۡلِي ٢٩ هَٰرُونَ أَخِي ٣٠ ٱشۡدُدۡ بِهِۦٓ أَزۡرِي ٣١ وَأَشۡرِكۡهُ فِيٓ أَمۡرِي ٣٢ كَيۡ نُسَبِّحَكَ كَثِيرٗا٣٣﴾ [طه: ٢٩،  ٣٣]

“আর আমার পরিবার থেকে আমার জন্য একজন সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দিন। আমার ভাই হারূনকে। তার দ্বারা আমার শক্তি সুদৃঢ় করুন। এবং তাকে আমার কাজে শরীক করুন। যাতে আমরা বেশী করে আপনার তাসবীহ পাঠ করতে পারি।” [সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ২৯-৩৩]

এমনিভাবে আল্লাহ ‘ঈসা আলাইহিস সালামকেও সাহায্য করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿وَإِذۡ أَوۡحَيۡتُ إِلَى ٱلۡحَوَارِيِّ‍ۧنَ أَنۡ ءَامِنُواْ بِي وَبِرَسُولِي قَالُوٓاْ ءَامَنَّا وَٱشۡهَدۡ بِأَنَّنَا مُسۡلِمُونَ١١١﴾ [المائ‍دة: ١١١]   

“আর যখন আমি হাওয়ারীগণকে এ আদেশ দিয়েছিলাম যে, আমার প্রতি তোমরা ঈমান আন ও আমার রাসূলের প্রতি। তারা বলেছিল, আমরা ঈমান আনলাম এবং আপনি সাক্ষী থাকুন যে, আমরা অবশ্যই মুসলিম।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ১১১]

তিনি সৃষ্টিকুলের সরদার মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও সাহায্য করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿هُوَ ٱلَّذِيٓ أَيَّدَكَ بِنَصۡرِهِۦ وَبِٱلۡمُؤۡمِنِينَ٦٢﴾ [الانفال: ٦٢]

“তিনিই তোমাকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর সাহায্য ও মুমিনদের দ্বারা।” [সূরা আল- আনফাল, আয়াত: ৬২] এটি আল্লাহর অনুগ্রহ যা বান্দার শক্তি-সামর্থ্যের বাইরে। আল্লাহর এ ধরণের অনুগ্রহের মধ্যে আরেকটি অনুগ্রহ তার হিদায়েত প্রাপ্ত বান্দাদের প্রতি হিদায়েত দান করা। যেহেতু তিনি যাকে হিদায়েত দান করতে চান তাকে তিনি তা দান করেন এবং তার থেকে তা কবুল করেন। ফলে তার আমলসমূহ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, যা বান্দা শুধু কাজের দ্বারা অর্জন করা সম্ভব নয়; বরং এটির শর্তই হচ্ছে এটি তাদের সাধ্যের বাহিরের বিষয়।

বান্দার ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ যে, তিনি তাদেরকে সন্তান-সন্তুতি, ধন-সম্পদ ও স্ত্রী দান করেন, যা দ্বারা সে দুনিয়ায় চক্ষু শীতল করে ও আনন্দ লাভ করে। অত:পর তিনি এসবের কিছু দ্বারা বান্দাকে পরীক্ষা করেন, কিছু তিনি নিয়ে নেন। এ কষ্টে ধৈর্যধারণ করলে এর বিনিময়ে তিনি মহা প্রতিদান দান করেন। বান্দাকে যা দান করা হয়েছে তা তার কাছে অবশিষ্ট থাকার চেয়ে তার থেকে তা নিয়ে যাওয়ার (এতে ধৈর্যধারণ করলে) সাওয়াব অধিক। এ কল্যাণ ও পুরস্কার বান্দার সাধ্যের বাইরে; বরং এটি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ যে, তিনি এর জন্য উপকরণ নির্ধারিত করে দিয়েছেন এবং এর বিনিময়ে অপরিসীম সাওয়াব ও উত্তম পুরস্কার দান করেন। আল্লাহর অনুগ্রহের আরেকটি হলো, তিনি বান্দাকে বালা-মুসিবত দিয়ে পরীক্ষা করেন এবং তাকে ধৈর্যধারণের শক্তি দিয়ে সাহায্য করেন। ফলে সে ধৈর্যধারণ করতে পারলে এমন সুউচ্চ মর্যাদা লাভ করে যা সে আমলের দ্বারা অর্জন করতে সক্ষম ছিল না। তিনি কারো প্রতি এ পরীক্ষার মাত্রা অধিক দিয়ে থাকেন, যেমন তিনি আইয়ূব আলাইহিস সালামের সাথে করেছেন। তিনি আবার তাকে প্রত্যাশা, রহমত ও মুসিবত দূরীকরণের স্বাদ আস্বাদনের মতো অন্তর দান করেছেন। ফলে তার কষ্ট হালকা হয়েছিল এবং অন্তর শক্তিশালী ছিল। এ কারণেই মুমিনের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ যে, তিনি তাদের অন্তরে প্রতিদান প্রাপ্তির ধৈর্য দান করেন। ফলে তারা মুসিবতে কষ্ট হালকা অনুভব করেন এবং তারা যে দু:খ-কষ্ট পেয়ে থাকেন তা তাদের রবের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হালকা মনে করেন।

বান্দার প্রতি আল্লাহ আরো অনুগ্রহ যে, তিনি দুর্বল মুমিন বান্দাকে নানা বালা-মুসিবতের উপকরণ দিয়ে শাস্তি দান করেন যা তাদের ঈমানকে বৃদ্ধি করে এবং গুনাহ মাফ করে দেয়। এমনিভাবে শক্তিশালী ঈমানদারের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ এভাবে যে, তিনি তাদেরকে নানা বালা-মুসিবত ও পরীক্ষার সম্মুখীন করান এবং সেগুলোর উপর ধৈর্যধারণ করতে ও ও সে কষ্ট সহ্য করতে সাহায্য করেন। এতে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়, সাওয়াব বহুগুণে বেড়ে যায়। অত:এব, সমস্ত প্রশংসা ও পবিত্রতা সে মহান অনুগ্রহশীল আল্লাহর যিনি বালা-মুসিবত, শাস্তি, দান ও দান করা থেকে বিরত রাখা ইত্যাদির দ্বারা বান্দার প্রতি অনুগ্রহ করেন।

বান্দার ওপর আল্লাহর আরেক ধরণের অনুগ্রহ, তিনি বান্দার ব্যক্তি সত্ত্বাকে সহজ পদ্ধতিতে পূর্ণতায় পৌঁছাতে সাহায্য করেন; কেননা যদি এর বিপরীত সত্ত্বার অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে তাহলে তা তাকে পূর্ণতার সে পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ফলে আল্লাহ বান্দাকে তাঁর কিতাব কুরআন মাজীদ শিক্ষা করতে সহজ করে দেন অথবা এমন একজন শিক্ষক নির্ধারিত করে দের যার দ্বারা তার লক্ষ্যে পৌঁছতে (কুরআন শিখতে) অতি কম সময় লাগে ও সহজেই সেখানে পৌঁছতে পারে। এমনিভাবে তাঁর অনুগ্রহ যে, তিনি বান্দাকে তাঁর ইবাদত করতে সহজ করে দেন এবং প্রতিবন্ধকতা দূর করে দেন।

বান্দার ওপর আল্লাহর আরো অনুগ্রহ যে, তিনি তাদের ওপর অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নানা ধরণের কাজ-কর্ম, দায়িত্ব, ব্যস্ততা, পরিচালনা ও এর আনুষঙ্গিকতা নির্ধারণ করে করে দিয়েছেন। সেসব দায়িত্ব যদি কিছু সংখ্যক মানুষকে দেওয়া হতো তাহলে তারা উত্তম চরিত্রে, প্রশস্ত হৃদয়ে ও বড় মনে তা পরিচালনা করতে অক্ষম হতো। তিনি তাকে তীক্ষ্মদৃষ্টি ও পূর্ণ পরিচালনা শক্তি দান করেছেন, সে কাজের এতো পরিমাণ ও ধরণ হওয়া সত্ত্বেও বিরক্ত ও অধৈর্য হয় না। বরং আল্লাহ তাকে  সেসব কাজ করতে সাহায্য করেন ও তার প্রতি অনুগ্রহ করেন। তিনি অনুগ্রহ করে তাকে সে কাজগুলো সহজভাবে আঞ্জাম দিতে তার জন্য সহজ উপকরণ ও পদ্ধতি দান করেন। আপনি এ বিষয়টি বিস্তারিতভাবে জানতে চাইলে আমাদের নবী মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে তাকান, তাকে আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ, সৌভাগ্য ও সফলতার জন্য প্রেরণ করেছেন, তিনি তাকে নিজের পূর্ণতা ও সর্বশ্রেষ্ঠ এ উম্মাতের পরিপূর্ণতার নিমিত্তে প্রেরণ করেছেন। এতদসত্ত্বেও আল্লাহ তাকে তার মহিমান্বিত জীবনের কিছু সময়ে- প্রায় এক তৃতীয়াংশেই তার সে মহান দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা দান করেছেন; যদিও তার কাজ ছিল অনেক, ধরণ ছিল নানাবিধ। তিনি এত অল্প সময়ে উম্মাতকে দীন শিক্ষা, দীনের যাবতীয় উসূল ও ফুরু‘ শিক্ষা দেওয়া, উম্মাতের এক বিরাট অংশকে অন্ধকার থেকে আলোর মিছিলে আনতে সক্ষম হওয়া, এতে উম্মাতের সাধারণ ও বিশেষ সকলের জন্য উভয় জাহানের কল্যাণ, উপকার ও সৌভাগ্য অর্জিত হয়েছে, যা উম্মাতের কেউ করতে সক্ষম হবে না।

বান্দার ওপর আল্লাহ আরেকটি অনুগ্রহ যে, তিনি বান্দাকে গুনাহের যেসব কিছু দ্বারা পরীক্ষা করেন তা তিনি তার জন্য রহমত লাভে অসীলা বানান। সুতরাং বান্দা গুনাহে পতিত হলে তিনি তার জন্য তাওবা, তাঁর সমীপে আকুতি-মিনতি, প্রার্থনা, নিজের হীনাতা ও নিচুতা প্রকাশ, নিজের মধ্য থেকে অহংকার দূর করে তাঁর সমীপে ফিরে আসার দরজা খুলে দেন, যা অনেক সময় আনুগত্যের সাওয়াবের চেয়েও উত্তম হয়ে থাকে।

আল্লাহর প্রিয় বান্দার প্রতি তাঁর অনুগ্রহের অন্যতম হচ্ছে, তার অন্তর যখন খারাপ প্রবৃত্তির লালাসায় ঝুঁকে পড়ে তখন তিনি তার অন্তরে আমলনামা বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় সৃষ্টি করে দেন, ফলে সে সম্পূর্ণ ভাবে ক্ষতিকর কাজে ঝুঁকে পড়ে না। এমনিভাবে বান্দার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ যে, তিনি তাদের অন্তরে তাঁর নৈকট্যের স্বাদ ও তাঁর আনুগত্যের মধুরতা ঢেলে দিয়েছেন যাতে তারা সম্পূর্ণ ভাবে এ সব কাজে ঝুঁকে পড়ে।

বান্দার ওপর আল-লাতীফ তথা সূক্ষ্মদর্শী, অমায়িক আল্লাহর অনুগ্রহ যে, সে যেসব আমল করে নি; বরং শুধু দৃঢ় নিয়াত করেছিল, সেসব নিয়াতের জন্যও তিনি সাওয়াব দান করেন। বান্দা তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য কোন কাজের দৃঢ় নিয়াত করেছিল, কিন্তু কোন কারণে সে কাজটি করতে সক্ষম হয় নি, ফলে আল্লাহ তার নিয়াতের বদৌলতে সে কাজের সাওয়াব দান করেন। সুতরাং লক্ষ্য করুন, বান্দার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ কত? তিনিই কাজটি বান্দার অন্তরে ঢেলে দেন, তিনিই তার অন্তরে কাজটি ঘুরিয়ে দেন; অথচ তিনি জানেন যে, বান্দা কাজটি করতে পারবে না। বান্দার প্রতি সকল পন্থায় তাঁর ইহসান পৌঁছাতে তিনি এমনটি করে থাকেন।

বান্দার প্রতি এরচেয়েও বেশি অনুগ্রহ যে, তিনি বান্দার জন্য পূর্বের দৃঢ় নিয়াতকৃত কাজটি ব্যতীত আরেকটি আনুগত্যের কাজ নির্ধারিত করে দেন, যা তার জন্য আরো অধিক সাওয়াবের। ফলে বান্দা পূর্বের আনুগত্যের কাজটি ছেড়ে আরো অধিক আনুগত্যের কাজটি করে যাতে রয়েছে আল্লাহর অধিক সন্তুষ্ট। ফলে তার বর্তমান কাজ ও পূর্বের কাজের নিয়াতের কারণে উভয় সাওয়াব অর্জিত হয়। যেমন, কোন ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হিজরত করতে রওয়ানা দিলো, অত:পর মাঝপথে মৃত্যু এসে গেলো, তখন তার হিজরতের সাওয়াব আল্লাহ দান করে দেন; যদিও মাঝপথে মৃত্যু তার (বান্দার) ইখতিয়ারে ছিলো না। এমনিভাবে যে ব্যক্তি আনুগত্যের মর্যাদাপূর্ণ দৃঢ় নিয়াত করে, সে কাজটি করার পরিপক্ক নিয়াত করেছিল, কখনো কখনো আল্লাহ বান্দার অন্তরে নানা ধরণের আনুগত্যের কাজ করার ইচ্ছা ঢেলে দেন। বান্দার পূর্ণ ইচ্ছা রয়েছে যে, সে আলাদা আলাদা ভাবে সেসব ভালো কাজগুলো সম্পন্ন করবে; কিন্তু একত্রে সব কাজ করা তার জন্য সম্ভব হয় না, ফলে আল্লাহ সেসব কাজের মধ্যে তুলনা করার তাওফিক দান করেন যে, কোনটি অধিক উত্তম ও সাওয়াবে। ফলে সে অধিক উত্তম ও সাওয়াবের কাজটি করতে পছন্দ করে; যদিও তার সব কাজ করার দৃঢ় নিয়াত ছিল।

বান্দার প্রতি আল্লাহর এরচেয়েও আরো অধিক দয়া যে, তিনি তাকে গুনাহের নানা উপকরণ দিয়ে সেসব গুনাহর কাজ করতে সক্ষমতা দান করেন, তাকে উক্ত গুনাহের কাজটি করতে পর্যাপ্ত উপায়-উপকরণ দিয়ে থাকেন; অথচ তিনি জানেন যে, বান্দা কাজটি করবে না। তথাপিও উপায়-উপকরণ বিদ্যমান থাকার পরে গুনাহের সে কাজটি ত্যাগ করা অধিক আনুগত্য ও সাওয়াবের কাজ। যেমন তিনি ইউসুফ আলাইহিস সালামের প্রতি নারীর (মিসরের বাদশার স্ত্রীর) কুপ্ররোচনায় দয়া করেছিলেন। কিয়ামতের দিনে যে সাত ধরণের লোক আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবেন তাদের মধ্যে সে ব্যক্তি যাকে প্রভাবশালী ও সুন্দরী অন্যায় কাজ করতে কুপ্ররোচনা করেছিল; কিন্তু সে তার আহ্বানের জবাবে বলেছিল, আমি রাব্বুল আলামীনকে ভয় করি।[5]

বান্দার প্রতি আল্লাহর দয়া যে, তিনি তাঁর বান্দার থেকে কল্যাণ ও ইহসান নির্ধারণ করে তা অন্য বান্দার দ্বারা সম্পন্ন করান এবং তাকে প্রথম ব্যক্তির জন্য মাধ্যম হিসেবে নির্ধারণ করেন। ফলে সে কল্যাণকর কাজের সাওয়াব প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় বান্দাই পেয়ে থাকেন। বান্দার প্রতি আরো অনুগ্রহ যে, তিনি তাদের সম্পদে দ্বারা অন্যের উপকার ও কল্যাণ সাধিত করান। ফলে সে অগণিত হারে সাওয়াব পেতে থাকে। যেমন কেউ তার সম্পদ থেকে বীজ বপন করলে বা চারা রোপন করলে সে খাদ্য থেকে কোন প্রাণী ভক্ষণ করলে আল্লাহ উক্ত সম্পদের মালিককে সাওয়াব দান করেন; যদিও সে তা জানে না। বিশেষ করে সে যদি ভালো নিয়াত করে এবং আল্লাহর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় যে, তার সম্পদ ভালো যে কোন কাজেই ব্যয় হোক সে এর বিনিময়ে সাওয়াব ও তাঁর নৈকট্য তালাশ করে। এমনিভাবে তার যদি পশু থাকে এবং এর দ্বারা আরোহণ, বোঝা বহন ইত্যাদি উপকারী কাজে ব্যবহৃত হয় অথবা ঘর থাকলে তাতে কেউ ক্ষণিকের জন্য হলেও বসবাস করলে অথবা পাত্রের দ্বারা উপকৃত হলে অথবা ঝর্ণা থেকে পানি পান করলে ইত্যাদি, এ ছাড়াও কিতাব দ্বারা শিক্ষা লাভ করে উপকৃত হলে অথবা কুরআন দ্বারা তিলাওয়াত করলে উক্ত জিনিসের মালিক সাওয়াবের অধিকারী হবে। আল্লাহ অতি দয়ালু, মহান।

বান্দার ওপর আল্লাহর আরেকটি বিশেষ দয়া যে, তিনি তার জন্য কল্যাণের এমন সব দরজা খুলে দেন যা সে কল্পনাও করে নি। যদিও এটি তার কম আগ্রহের কারণে নয়; বরং এটি তার অসচেতনতা ও ভুলে যাওয়ার কারণে হয়ে থাকে। তার অন্তরে এ কাজটি করার চাহিদা উদায় হওয়া ব্যতীত সে এটি অনুভব করতে পারে না। সুতরাং তার অন্তরে সে কাজটি করার চাহিদা অনুভব হলে সে আনন্দিত হয় এবং বুঝতে পারে যে, এটি তার মহা মালিক মহান আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনিই তাকে এ কাজটি করতে নড়া দিয়েছেন, ফলে তার অন্তর এ দিকে ঝুকেছে, তার চিন্তাশক্তি এ কাজটি করতে স্থির করেছে এবং আল্লাহ যা চান তা বুঝতে পারেন।[6]


[1] আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿لَّا تُدۡرِكُهُ ٱلۡأَبۡصَٰرُ وَهُوَ يُدۡرِكُ ٱلۡأَبۡصَٰرَۖ وَهُوَ ٱللَّطِيفُ ٱلۡخَبِيرُ١٠٣﴾ [الانعام: ١٠٣]

“চক্ষুসমূহ তাকে আয়ত্ব করতে পারে না। আর তিনি চক্ষুসমূহকে আয়ত্ব করেন। আর তিনি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবহিত।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১০৩]

[2] তাওদীহুল কাফিয়া আশ-শাফিয়া, পৃ. ১২৩; আত-তাফসীর, ৫/৬২৫।

[3] তিরমিযী, ৫/৫২৩, কিতাব দাওয়াত, হাদীস নং ৩৪৯১, ইমাম তিরমিযী রহ. হাদীসটিকে হাসান গরীব বলেছেন। আব্দুল কাদির আরনাঊত বলেছেন, ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন, দেখুন জামু‘উল উসূল, ৫/৩৪১; আলবানী রহ. হাদীসটিকে দ‘ঈফ বলেছেন, দেখুন, দ‘ঈফুল জামে‘, পৃ. ৪৫৩-৪৫৪।

[4] আল-হাক্কুল ওয়াদিহ আল-মুবীন, পৃ. ৬১-৬২।

[5] এটি আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসের অর্থ বিশেষ। হাদীসটি বুখারী ৮/২০, কিতাবুল হুদুদ, বাব, ফাহিশা কাজ ত্যাগের ফযিলত এবং মুসলিম ২/৭১৫, কিতাবুদ দো‘আ, বাব, গোপনে সাদকা করার ফযিলত পরিচ্ছেদে বর্ণিত আছে।

[6] আল-মাওয়াহিবুর রাব্বানিয়্যাহ মিনাল আয়াতিল কুরআনিয়্যাহ, পৃ. ৭১-৭৬।

Jahirul.Islam

Share
Published by
Jahirul.Islam

Recent Posts

How Much Paint to Paint a Car?

If you're planning to give your car a new look, one of your first questions…

16 hours ago

How Much Does It Cost to Build a Barndominium in 2025

If you're thinking about building a barndominium in 2025, you're not alone. These barn-style homes…

6 days ago

How Long Does It Take to Charge a Car Battery

A dead or drained car battery can be a frustrating issue, especially when you're in…

7 days ago

How Can I Plan a Trip to PR by Myself

Dreaming of a tropical escape but want to explore on your own terms? If you’ve…

7 days ago

How to Teach My Four Year Old to Share

Teaching your child to share is one of the most valuable lessons they’ll learn in…

7 days ago

How to Dispose of Old Gasoline Safely and Legally

Old gasoline sitting in your garage or shed can pose serious risks to your health,…

7 days ago