প্রিয় ভাই সকল! আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ইমামগণ কবরের শাস্তি এবং শান্তির ব্যাপারে ঈমান আনা ওয়াজিব হওয়ার যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তা এখানে তুলে ধরলাম।
প্রত্যেক মানুষ (নিম্নের) তিনটি স্তর অতিক্রম করে থাকে।
- ইহকালীন জীবন
- বারযাখী জীবন
- পরকালীন জীবন বা চিরস্থায়ী জীবন, যার কোনো শেষ নেই।
বারযাখী জীবন একটি বিরাট জীবন, যেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষা রয়েছে, হয় শান্তি না হয় শাস্তি, যা কুরআনের আয়াত এবং হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত। আর এটাই সালাফ এবং ইমামদের তরীকা যে, যখন কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হয় তখন সে শান্তি না হয় শাস্তিতে থাকে।
রূহ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর শাস্তিতে অথবা শান্তিতে বাকী থেকে যাবে, কখনো শরীরের সাথে সম্পৃক্ত হলে তখন রূহের সাথে শরীরেরও শান্তি বা শাস্তি হবে। অতঃপর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সে দিন রূহকে শরীরে ফিরিয়ে দেওয়া হলে তার রবের জন্য কবর থেকে উঠে দাঁড়াবে।[1]
কুরআনের যে সকল আয়াত দ্বারা কবরের শাস্তি প্রমাণিত হয় তা এই: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَحَاقَ بَِٔالِ فِرۡعَوۡنَ سُوٓءُ ٱلۡعَذَابِ ٤٥ ٱلنَّارُ يُعۡرَضُونَ عَلَيۡهَا غُدُوّٗا وَعَشِيّٗاۚ وَيَوۡمَ تَقُومُ ٱلسَّاعَةُ أَدۡخِلُوٓاْ ءَالَ فِرۡعَوۡنَ أَشَدَّ ٱلۡعَذَابِ ٤٦﴾ [غافر: ٤٥، ٤٦]
“ফির‘আউন গোত্রকে শোচনীয় ‘আযাব গ্রাস করল, সকাল সন্ধায় তাদেরকে আগুনের সম্মুখে পেশ করা হয় এবং যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সে দিন আদেশ করা হবে, ফির‘আউন গোত্রকে কঠিনতম ‘‘আযাবে পেশ করাও।” [সূরা গাফির, আয়াত: ৪৫-৪৬]
হাফেজ ইবন হাজার রহ. এ আয়াতের তাফসীরে বলেন, ফির‘আউন এবং তার অনুসারীদের রূহসমূহ কিয়ামত পর্যন্ত সকাল-সন্ধায় আগুনের সম্মুখীন করা হবে, যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে তখন তাদের রূহ এবং শরীর গুলো আগুনে একত্রিত করা হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَحَاقَ بَِٔالِ فِرۡعَوۡنَ سُوٓءُ ٱلۡعَذَابِ ٤٥ ٱلنَّارُ يُعۡرَضُونَ عَلَيۡهَا غُدُوّٗا وَعَشِيّٗاۚ وَيَوۡمَ تَقُومُ ٱلسَّاعَةُ أَدۡخِلُوٓاْ ءَالَ فِرۡعَوۡنَ أَشَدَّ ٱلۡعَذَابِ ٤٦﴾ [غافر: ٤٥، ٤٦]
“ফির‘আউন গোত্রকে শোচনীয় ‘আযাব গ্রাস করল, সকাল সন্ধায় তাদেরকে আগুনের সম্মুখে পেশ করা হয় এবং যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সে দিন আদেশ করা হবে, ফির‘আউন গোত্রকে কঠিনতম ‘আযাবে পেশ করাও।” [সূরা গাফির, আয়াত: ৪৫-৪৬]
ব্যাখ্যা: যন্ত্রনার দিক দিয়ে কঠিন এবং অপমানের দিক দিয়ে বড়। এ আয়াতটি কবরে বারযাখের শাস্তির ওপর প্রমাণিত আহলে সুন্নাতের মূল দলীল। আর এটাই আল্লাহর বাণী:
﴿ٱلنَّارُ يُعۡرَضُونَ عَلَيۡهَا غُدُوّٗا وَعَشِيّٗاۚ﴾ [غافر: ٤٦]
“সকাল সন্ধায় তাদেরকে আগুনের সম্মুখীন করা হবে।” [সূরা গাফির, আয়াত: ৪৬][2]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَوۡمَ لَا يُغۡنِي عَنۡهُمۡ كَيۡدُهُمۡ شَيۡٔٗا وَلَا هُمۡ يُنصَرُونَ ٤٦ وَإِنَّ لِلَّذِينَ ظَلَمُواْ عَذَابٗا دُونَ ذَٰلِكَ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ ٤٧﴾ [الطور: ٤٦، ٤٧]
“অতঃপর তাদেরকে সেদিন পর্যন্ত অবকাশ দিন, যেদিন তাদের ওপর বজ্রাঘাত পতিত হবে। সেদিন তাদের চক্রান্ত কোনো কাজে আসবে না এবং তাদেরকে কোনো সাহায্য করা হবে না। আর যালিমদের জন্য এ ছাড়াও রয়েছে অন্য শাস্তি। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা জানে না।” [সূরা আত-তূর, আয়াত: ৪৫-৪৭]
আল্লাহর এ বাণী:
﴿وَإِنَّ لِلَّذِينَ ظَلَمُواْ عَذَابٗا دُونَ ذَٰلِكَ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ ٤٧﴾ [الطور: ٤٧]
“আর যালিমদের জন্য এ ছাড়াও রয়েছে অন্য শাস্তি; কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা জানে না” [সূরা আত-তূর, আয়াত: ৪৭] দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, বারযাখে শাস্তি হওয়া; যেমন ইবন কাইয়্যুম তার কিতাবে (আর-রূহে) ইঙ্গিত দিয়েছেন।[3]
তিনি বলেন, এ আয়াত দ্বারা একটি বড় জামা‘আত কবরের ‘আযাবের ওপর দলীল সাব্যস্ত করেছে। তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা একজন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে সকল সহীহ হাদীস কবরের ‘আযাব সাব্যস্ত করে তা অনেক মুস্তাফিজ হাদীস (যার সনদে দু’জন করে সাহাবী রয়েছে) এবং কতিপয় উলামা তা মুতাওয়াতির বলেছেন।[4] তার মধ্যে বারা ইবন ‘আযিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীস, যা সুনান (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ এবং ইবন মাজাহ) ও মুসনাদে এসেছে। আর আমি পূর্বে যা উল্লেখ করেছি তাই বর্ণনার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ।
কবরের ‘আযাব সাব্যস্তকারী হাদীসগুলো নিম্নরূপ:
ইমাম বুখারী তার সহীহ বুখারীতে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার হাদীস নিয়ে এসেছেন, তিনি বলেন, একদা এক ইয়াহূদী মহিলা তার নিকট এসে কবরের ‘আযাবের কথা উল্লখ করলে তিনি বলেন, আল্লাহ তোমাকে কবরের ‘আযাব থেকে রক্ষা করুন। অতঃপর তিনি কবরের ‘আযাব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, কবরের ‘আযাব সত্য।[5]
আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, এর পর যখনই তাঁকে সালাত পড়তে দেখেছি তখনই তিনি কবরের ‘আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন।
আসমা বিনতে আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবায় দাঁড়িয়ে কবরের ফিতনা উল্লেখ করেছেন, যেখানে মানুষ ফিতনার সম্মুখীন হবে। তা উল্লেখ করার সাথে সাথে সাহাবীগণ আর্তনাদ করতে শুরু করলেন। ইমাম নাসাঈ আসমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার কথাটি আরো সামান্য বৃদ্ধি করে বলেন যে, সাহাবীগণ চিৎকার করায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেষ কথাটি আমার বুঝতে অসুবিধা হলো। তাদের চিৎকার একটু থামলে আমার নিকটবর্তী একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, আল্লাহ তোমায় বরকত দিন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর শেষ কথায় কী বলেছেন? বললেন, তিনি বলেছেন, (আমার নিকট অহী এসেছে যে, নিশ্চয় তোমরা কবরে ফিতনার সম্মুখীন হবে, যা দাজ্জালের ফিতনার সমকক্ষ প্রায়।[6]
যায়েদ ইবন সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে বনী নাজ্জারের একটি বাগানে তাঁর খচ্চরের উপর ছিলেন। আমরাও তাঁর সাথে ছিলাম। হঠাৎ তাঁর খচ্চরটি এমনভাবে লাফাচ্ছিল যে, তাঁকে ফেলে দেওয়ার উপক্রম হলো। তখন তিনি সামনে ৪/৫টি বা ৬টি কবর দেখতে পেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, এ কবরবাসীদেরকে কেউ চেন কি?
এক ব্যক্তি বলল আমি চিনি।
তিনি বললেন: তারা কখন মারা গেছে?
বলল: মুশরিক অবস্থায় মারা গেছে।
তিনি বললেন: নিশ্চয় এ উম্মত কবরের পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। যদি তোমরা তাদেরকে দাফন না করতে তাহলে কবরের শাস্তি আমি যা শুনি তোমাদেরকেও তা শুনানোর জন্য আল্লাহর নিকট দো’আ করতাম। অতঃপর তিনি আমাদের দিকে ফিরে বললেন, তোমরা আল্লাহর নিকট কবরের ‘আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা কর। তারা বলল, তখন আমরা আল্লাহর নিকট কবরের ‘আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করলাম। তিনি বললেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফিতনা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাও। তারা বলল, তখন আমরা আশ্রয় চাইলাম। তিনি দাজ্জালের ফিতনা থেকে আশ্রয় চাইতে বললে আমরা আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইলাম।[7]
সহীহ মুসলিমে এবং সুনানের কিতাবসমূহে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “যখন তোমাদের কেউ সালাতে শেষ তাশাহ্হুদ সমাপ্ত করবে তখন আল্লাহর নিকট চারটি জিনিস থেকে আশ্রয় চাইবে, (জাহান্নাম ও কবরের ‘আযাব থেকে, জীবন মৃত্যুর ফিতনা থেকে এবং মাসীহ দাজ্জালের ফিতনা থেকে)।”[8]
কবরের ‘আযাবের হাকীকতের ওপর প্রমাণীত দলীলসমূহ যা ইমাম মুসলিম রহ. তার সহীহ মুসলিমে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নের দো‘আটি তাদেরকে এমনভাবে শিক্ষা দিতেন, যেমনভাবে কুরআনের কোনো সূরা শিক্ষা দিতেন।[9]
দো‘আটি হলো:
«اللهم إني أعوذبك من عذاب جهنم وأعوذبك من عذاب القبر واعوذبك من فتنة المحيا والممات واعوذبك من فتنة المسيح الدجال».
“হে আল্লাহ আমি তোমার নিকট জাহান্নামের ‘আযাব, কবরের ‘আযাব, জীবন মৃত্যুর ফিতনা এবং মাসীহ দাজ্জালের ফিতনা থেকে আশ্রয় চাচ্ছি।”
বুখারী ও মুসলিমে আবূ আইয়ুব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা গোধূলির সময় বের হলে একটি আওয়াজ শুনতে পেয়ে তিনি বললেন, ইয়াহূদীদের কবরে শাস্তি হচ্ছে।[10]
প্রিয় ভাইসকল, পূর্বের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কবরে মানুষের একটি অন্য রকম জীবন রয়েছে, যার বৈশিষ্ট্য আলাদা এবং এতে শরীরের সাথে রূহের যে সম্পর্ক তা একটি বিশেষ সম্পর্ক। মানুষের জীবনে শান্তি বা শাস্তি লাভ হবে পৃথিবী জীবনের প্রেরিত আমল অনুযায়ী।বারযাখী জীবন একটি অদৃশ্য জীবন, কুরআন ও হাদীস দ্বারা যেভাবে প্রমাণিত হয় সেভাবেই ঈমান আনা আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলার তাওফীকে অতি শিঘ্রই তা বিশ্লেষণাকারে বর্ণনা করব। সেই সাথে কবরের ‘আযাব বা শাস্তিসহ এর সাথে সম্পৃক্ত কতগুলো মাসআলা বৃদ্ধি করে আলোচনা করব। আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি, যিনি দানশীল, তিনি যেন আমাদের এবং আমাদের পিতা-মাতাসহ সকল মুসলিম ভ্রাতৃবৃন্দের কবরকে জান্নাতের বাগিচা বানিয়ে দেন।