এ বিষয়ে আল্লামা ইবনুল কাইয়্যম রহ. তার অন্যতম কিতাব (আর রূহে) একটি নজীর বিহীন অনুচ্ছেদ নিয়ে এসেছেন, সংক্ষিপ্তাকারে তা তুলে ধরা হলো-
তিনি যে কথা দ্বারা শুরু করেছেন তা হলো এই যে, প্রশ্নকারী বলল: কী কী কারণে কবরবাসীদের সাজা হয়? এর উত্তর দু’ভাবে দেওয়া যায়। প্রথমতঃ সংক্ষিপ্তাকারে, দ্বিতীয়তঃ বিস্তারিত।
সংক্ষিপ্ত উত্তর: আল্লাহ সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা, তাঁর নির্দেশ অমান্য করা এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার জন্য তাদের শাস্তি হয়। পক্ষান্তরে যে রূহ আল্লাহকে চিনেছে, তাঁকে ভালোবেসেছে, তাঁর নির্দেশ পালন করেছে এবং নিষেধাবলী থেকে বিরত থেকেছে, তাকে তিনি শাস্তি দেন না এবং এ রূহ যে শরীরে থাকবে তাকেও শাস্তি দিবেন না। কেননা কবরের শাস্তি এবং শান্তি বান্দার ওপর আল্লাহর গোস্বা ও সন্তুষ্টির নিদর্শন।[1]
এ পৃথিবীয় যার ওপর আল্লাহ ক্রোধান্বিত ও অসন্তুষ্ট হবেন, অতঃপর সে যদি তাওবা না করে মারা যায়, তবে তার বারযাখের ‘আযাব আল্লাহর ক্রোধ এবং অসন্তুষ্টি অনুযায়ীই হবে। কাজেই কেউ কম করুক আর বেশি করুক বা বিশ্বাস করুক বা না করুক যা হবার তা হবেই।
বিস্তারিত উত্তর: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই দু’ব্যক্তি সম্পর্কে বলেছেন, যাদেরকে তাদের কবরে শাস্তি হতে দেখেছেন। তাদের একজন মানুষের গীবত করে বেড়াতো আর অপরজন প্রশ্রাব করে পবিত্রতা অর্জন করতো না। কাজেই এ লোক অবশ্যই পবিত্রতা ত্যাগ করেছে এবং অপরজন তার কথা দ্বারা মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির কারণ অবলম্বন করেছে যদিও সে সত্য বলে থাকে।
এতে এ সংকেত রয়েছে যে, মানুষের মধ্যে মিথ্যা কথা, মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান এবং অপবাদের দ্বারা বিভেদ সৃষ্টিকারীর সবচেয়ে বড় পাপ হবে, তেমনিভাবে পেশাব থেকে পবিত্রতা অর্জন ত্যাগ করার মধ্যে এই সংকেত রয়েছে যে, যে ব্যক্তি ওয়াজিব ও শর্ত বিশিষ্ট সালাত ত্যাগ করে যাতে পেশাব থেকে পবিত্রতা অর্জন প্রয়োজন, তারও সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে। অন্য বর্ণনায় এসেছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যাদের শাস্তি হচ্ছিল তাদের একজন যে ব্যক্তি মানুষের গোশত খাচ্ছিল সে ছিল গীবতকারী, আর অন্যজন ছিল ফিতনা সৃষ্টিকারী। তার নিকট থেকে এ বর্ণনাও এসেছে যে, এক ব্যক্তিকে বেত্রাঘাত করা হলে তার কবর আগুনে ভরপুর হয়ে গেল, কেননা সে একবার বিনা অযুতে সালাত পড়েছিল এবং নির্যাতীত মানুষের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেছিল; কিন্তু তাকে সাহায্য করে নি।
ইমাম বুখারী রহ. কর্তৃক বর্ণিত, সামুরা ইবন জুন্দুব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর হাদীসে এক মিথ্যাচারের কাহিনী এসেছে, যার মিথ্যা সংবাদ দিক বিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তার শাস্তি হলো কুরআন পড়ুয়া সেই ব্যক্তির ন্যায় যে কুরআন না পড়ে রাত্রে শুয়ে যেত এবং দিনের বেলায় কোনো আমল করতো না। তার শাস্তিসহ ব্যভিচার নর-নারী এবং সূদখোরের শাস্তি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন। বারযাখে যেভাবে শাস্তি হতে দেখেছেন সেভাবেই সংবাদ দিয়েছেন। অন্য হাদীসে এসেছে কতগুলো লোকের মাথায় পাথর দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে, তাদের কারণ ছিল তারা সালাতের ব্যাপারে শিথিলতা করতো আর যারা যরী নামক ঘাস ও যাক্কুমের মধ্যবর্তীতে ঘুরাঘুরি করছে তাদের কারণ হলো -তারা তাদের মালের যাকাত দেয় নি এবং যারা দুর্গন্ধযুক্ত গোশত খাচ্ছে তার কারণ, তারা ছিল ব্যভিচারী। যাদের ঠোঁটসমূহ লোহার কাছি দিয়ে কাটা হচ্ছে তার কারণ তারা তাদের কথা এবং বক্তব্যের দ্বারা ফিতনা সৃষ্টি করেছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে কতিপয় অপরাধের হোতা এবং তাদের শাস্তি সম্পর্কে এসেছে যে, তাদের মধ্যে যে সকল লোকের পেট ঘরের ন্যায় বড়, তারা ফির‘আউন গোত্রের পদাঙ্ক অনুসারী এবং সূদখোর, কিছু লোককে তাদের মুখ হা করিয়ে জ্বলন্ত অঙ্গার খাওয়ানো হচ্ছে যতক্ষণ না তা তাদের পিছন দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আর তারা হচ্ছে এতীমদের ধন সম্পদ ভক্ষনকারী। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মহিলা রয়েছে, যারা তাদের স্তনের মাধ্যমে ঝুলে রয়েছে। তারা হচ্ছে ব্যভিচারিনী। সেখানে কতিপয় লোকের পার্শ্ব কর্তন করা হচ্ছে এবং তাদেরকে গোশত খাওয়ানো হচ্ছে। তারা হলো গীবতকারী। তাদের মধ্যে যারা শিশার নোখ দ্বারা নিজেদের মুখমণ্ডলে দাগ কাটছে তারা হলো মানুষের মান-সম্মান বিনষ্টকারী এবং যারা গণিমতের মাল আত্মসাৎ করেছিল তাদের কবরে তাদের উপর আগুন জ্বলছে। এ ব্যক্তির অবস্থা যদি এই হয় অথচ সেখানে (গণীমতে) তার হক রয়েছে তাহলে যে ব্যক্তি অন্যকে যুলুম করে, যেখানে তার কোনো হক নেই তার অবস্থা কী হবে? সুতরাং অন্তর, চোখ, কান, নাক, মুখ, জিহ্বা, লজ্জাস্থান, হাত-পা এবং শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের পাপই কবরে ‘আযাবের কারণ হবে। কাজেই পরনিন্দাকারী, মিথ্যাবাদী, গীবতকারী, মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা, সতীসাধ্বী নারীকে অপবাদ দানকারী, ফিতনা সৃষ্টিকারী এবং বিদ‘আতের দিকে মানুষকে আহ্বানকারী, তেমনি ভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর মিথ্যারূপকারী, আন্দাজে বাক্যালাপকারী, সূদখোর, এতীমদের সম্পদ ভক্ষনকারী, হারাম উপার্জন যেমন, সূদ… ইত্যাদি ভক্ষনকারী, অন্যায় ভাবে কোনো মুসলিম ভাইয়ের মাল বা সন্ধিকারী ব্যক্তির মাল ভক্ষনকারী, নেশাখোর, ব্যভিচারী, সমকামী, চোর, খেয়ানতকারী, গাদ্দার, ধোঁকাবাজ, মক্করবাজ, সূদ গ্রহীতা এবং দাতা, এর লেখক, সাক্ষীদ্বয়, হিল্লাদাতা ও গ্রহীতা, আল্লাহর ফরয করা কোনো বিধান রহিত করার কৌশল অবলম্বন কারী, হারামে পতিত ব্যক্তি, মুসলিমকে কষ্ট দানকারী, তাদের দোষ ত্রুটি অন্বেষনকারী, মানব রচিত বিধান দ্বারা শাসনকারী, আল্লাহর শরী‘আত ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা ফাতাওয়া দানকারী, পাপ কর্মে এবং শত্রুতায় সাহায্যকারী, হত্যাকারী, আল্লাহর কোনো হালালকে হারামকারী, আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর হাকীকত অস্বীকারকারী এবং তা রহিতকারী, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের ওপর কারো সিদ্ধান্ত, রুচি, এবং নীতিকে প্রাধান্য দানকারী, মৃতের ওপর ক্রন্দনকারিনী এবং তা শ্রবণকারিনী মহিলা, জাহান্নামের ক্রন্দনকারী পুরুষ, অর্থাৎ আল্লাহ ও তদ্বীয় রাসূলের হারাম করা গান গায়ক, তার গান শ্রবণকারী, কবরের উপর মাসজিদ নির্মাণকারী, তাতে চেরাগ দাতা ও বাতি দানকারী, ওজনে কম-বেশি দাতা, যালিম, অহঙ্কারী, লোক দেখানো আমলকারী, পশ্চাতে ও সামনে পর নিন্দাকারী, সালাফদেরকে অপবাদ দাতা, গণক ও জ্যোতিষীর নিকট কিছু জানতে চাওয়া এবং তাতে বিশ্বাস এবং যালিমদের সহযোগী। তেমনি ভাবে পরকালকে ইহকালের পরিবর্তে বিক্রেতা, যাকে আল্লাহর ভয় ভীতি স্মরণ করিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও কোনো ভ্রুক্ষেপ বা ভয় করে না কিন্তু যখন তাকে তার মতোই কোনো সৃষ্টি জীবের ভয় দেখানো হয় তখন তাকে ভয় করে এবং পুরোপুরি মেনে চলে এবং স্বীয় কাজ কর্মে ফিরে আসে। যে ব্যক্তিকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণী দ্বারা হিদায়াত করা হলে সে হিদায়াত হতে চায় না; কিন্তু যখন তার কোনো প্রিয় লোকের কথা বলা হয়, যার কথা ভুলও হতে আবার সঠিকও হতে পারে, তখন সে শক্ত ভাবে তা আঁকড়ে ধরে, তার কোনো বিরোধিতা করে না, যার কুরআন পাঠে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না; বরং কখনো তা বিরক্তবোধ করে কিন্তু যখন শয়তানের কথা, ব্যভিচারের ঝাড়ফুঁক ও নেফাকের উপকরণ শুনে তখন তার আনন্দ বেড়ে যেত আর ভাবতো হায়! গায়িকা যদি না থামিত। আল্লাহর নামে মিথ্যা শপথ করে কিন্তু যখন কোনো অলী বা শাইখের মাথার বা তার বাবার যা সৃষ্টি জীবের সেরা পছন্দনীয় ব্যক্তির জীবনের কসম করে তখন মিথ্যা বলে না, যদিও তাকে ধমক দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি অপরাধ নিয়ে গর্ববোধ করে এবং বন্ধু মহলে প্রকাশ্যে আরো অধিক করতে থাকে, যার নিকট আপনার ধন-সম্পদের কোনো নিরাপত্তা নেই, সেই অশ্লীল চাপাবাজ যার অনিষ্টতা এবং গাল-মন্দের ভয়ে মানুষ তাকে ত্যাগ করে, যে ব্যক্তি সালাতকে শেষ ওয়াক্ত পর্যন্ত দেরি করে ঠুকর দেয় (তাড়াতাড়ী আদায় করে) এবং এতে আল্লাহকে খুব কম স্মরণ করে, স্বেচ্ছায় যে ব্যক্তি মালের যাকাত আদায় করে না, হজের সামর্থ থাকা সত্ত্বেও হজ করে না, শক্তি থাকা সত্ত্বেও তার নিজের হক আদায় করে না এবং যে ব্যক্তি সাক্ষাতে, আচার ব্যবহারে এবং খাওয়া দাওয়ায় শালিনতা বজায় রাখে না। তেমনি অর্জিত মালের হালাল হারামের পরোয়া করে না, আত্মীয়তা সম্পর্ক বজায় রাখে না, মিসকীন, বিধবা এবং এতীমদের দয়া করে না; বরং তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়, মিসকীনদের অন্ন দিতে মানুষকে উৎসাহ দেয় না, চতুষ্পদ জন্তুর প্রতি অনুগ্রহ করে না। যে বিশ্ববাসীকে দেখানোর জন্য কাজ করে, নিজের ব্যবহারিক জিনিস অন্যকে দিতে নিষেধ করে এবং নিজের দোষ-ত্রুটি ও অপরাধ ঢেকে রেখে অন্যের দোষ ও অপরাধ নিয়ে মেতে থাকে।
উল্লিখিত লোক এবং তাদের মতো সকলেই এ সকল অপরাধের কারণে কম বেশি ও ছোট-বড় অনুপাতে তাদের কবরে শাস্তি হবে যতক্ষণ না আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে তাদের অপরাধ এড়িয়ে যাবেন।
আর যদি অধিকাংশ লোকই এ রকম হয়, তবে অধিকাংশ কবরবাসীও সাজাপ্রাপ্ত হবে এবং সফলকাম খুব কমই হবে। কাজেই কবরের উপরিভাগ মাটি আর ভিতরে হায় হোতাশ ও শাস্তি। এর উপরিভাগ মাটি ও নকশী পাথর দ্বারা বাঁধানো আর ভিতরে বিপদ ও জ্বালা-যন্ত্রনার গোডাউন। রান্নার সময় পাত্রে কোনো জিনিস যেভাবে উতরে উঠে সেভাবে তারা আক্ষেপে উতরে উঠছে। তাদের জন্য ইহাই প্রযোজ্য; অথচ এগুলো কবর ও এর প্রবৃত্তি তাদের আশা আকাঙ্খার মাঝে বিরোধ সৃষ্টি করেছে।আল্লাহর শপথ! অবশ্যই আমি উপদেশ দিয়েছি, অন্য কারো জন্য তা বাকী রাখি নি, সেই সাথে আহ্বান করি যে, হে পৃথিবী আবাদকারীগণ! আপনারা এমন পৃথিবীকে আবাদ করছেন, যা আপনাদেরকে নিয়ে অতি শিঘ্রই নিঃশেষ হয়ে যাবে অথচ আপনারা সেই ঘরকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন যার দিকে খুব দ্রুত ধাবমান হচ্ছেন। অন্যের উপকার এবং বসবাসের জন্য ঘর তৈরি করছেন, পক্ষান্তরে নিজের সেই ঘরকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন যা ব্যতীত আপনার কোনো ঘর থাকবে না। তা চিরস্থায়ী ঘর, আমলের গোডাউন এবং ক্ষেতের বীজ, তা যেমনভাবে উপদেশ গ্রহণের জায়গা, জান্নাতের বাগিচা তেমনিভাবে জাহান্নামের গুহাও বটে।