মহিলা সাহাবাদের কাহিনী

দ্বীনের উপর অবিচলতা

[আলহামদুলিল্লাহ। ওয়াছ ছালাতু ওয়াস সালামু ‘আলা রাসূলিল্লাহ, আম্মা বাদ। গত ৮-১০ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে দুবাইয়ে অবস্থিত মসজিদে খাদীজা বিনতু খুওয়াইলিদে ঊর্দূভাষী ভাইদের উদ্দেশ্যে তিন দিনব্যাপী একটি প্রশিক্ষণ কোর্স অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে ওলামায়ে কেরাম ঊর্দূ ভাষায় তাদের জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তন্মধ্যে শায়খ যাফরুল হাসান মাদানী হাফিযাহুল্লাহ ‘ইসতিক্বামাত’ তথা দ্বীনের উপর অবিচলতা সম্পর্কে অতি মূল্যবান একটি প্রবন্ধ পেশ করেন। প্রবাসে অনুষ্ঠিত এমন ইলমী প্রোগ্রামে বাংলাভাষী ভাইয়েরাও ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু ভাষার ভিন্নতার কারণে বিষয় অনুধাবনে যথেষ্ট ঘাটতি থেকেই যায়। সেকারণ প্রবন্ধটির গুরুত্ব বিবেচনায় বাংলাভাষী ভাই-বোনদের উপকারার্থে প্রবন্ধটির অনুবাদ পত্রস্থ করা হ’ল। -অনুবাদক]

আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوْا وَلَا تَحْزَنُوْا وَأَبْشِرُوْا بِالْجَنَّةِ الَّتِيْ كُنْتُمْ تُوعَدُوْنَ، نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَدَّعُوْنَ، نُزُلًا مِنْ غَفُوْرٍ رَحِيْمٍ- ‘নিশ্চয়ই যারা বলে আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ। অতঃপর তার উপর অবিচল থাকে, তাদের উপর ফেরেশতামন্ডলী নাযিল হয় এবং বলে যে, তোমরা ভয় পেয়ো না ও চিন্তান্বিত হয়ো না। আর তোমরা জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর, যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেওয়া হয়েছিল। আমরা তোমাদের বন্ধু ইহকালে ও পরকালে। আর সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা তোমাদের মন চাইবে এবং সেখানে রয়েছে যা তোমরা দাবী করবে। এটা হবে ক্ষমাশীল ও অসীম দয়ালুর পক্ষ থেকে আপ্যায়ন’ (হা-মীম সাজদা ৪১/৩০-৩২)।

তিনি আরও বলেন,إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ، أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ خَالِدِيْنَ فِيْهَا جَزَاءً بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ، ‘নিশ্চয়ই যারা বলে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। অতঃপর এ কথার উপর অবিচল থাকে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না। তারা হবে জান্নাতের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে এবং এটা হবে তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান’ (আহকাফ ৪৬/১৩-১৪)।

আবু বকর (রাঃ) বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا، -এর অর্থ হ’ল, তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য মা‘বূদের দিকে ভ্রূক্ষেপ করে না।[1]

ইমাম যুহরী (রহঃ) বলেন, ওমর (রাঃ) একদা এই আয়াতটি মিম্বরে তেলাওয়াত করে বলেন, তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাঁর ইবাদতের উপর অটল থাকে এবং শিয়ালের মত এদিক ওদিক পলায়ন করে না।[2]

ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ইসতিক্বামাতের অর্থ হ’ল, على أداء فرائضه অর্থাৎ ‘আল্লাহর ফরয ইবাদত পালনে অটল থাকা’।[3]

ক্বাতাদাহ (রহঃ) বলেন, হাসান বাছরী (রহঃ) দো‘আ করতেন, اللهم أنت ربنا، فارزقنا الاستقامة ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের রব। তুমি আমাদেরকে তোমার দ্বীনের উপর অটল থাকার তাওফীক দাও’।[4]

আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন ‘আছ (রাঃ) বলেন, একদা মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) সফর করার ইচ্ছা করলে তিনি আল্লাহর রাসূলকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাকে অছিয়ত করুন। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, اعْبُدِ اللهَ وَلَا تُشْرِكْ بِهِ شَيْئًا، ‘একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক কর না’।

তিনি বললেন, হে আল্লাহর নবী! আরো বেশী করুন। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, وَإِذَا أَسَأْتَ فَأَحْسِنْ ‘পাপের পরে নেকীর কাজ করবে’। অতঃপর তিনি আরও অছিয়ত করার আবেদন জানালে নবী করীম (ছাঃ) বললেন,اسْتَقِمْ وَلْتُحَسِّنْ خُلُقَكَ، ‘দ্বীনের উপর অটল থাক এবং তোমার চরিত্রকে উত্তম করে গড়ে তোল’।[5]

এই হাদীছে আল্লাহর রাসূল মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ)-কে দ্বীনের উপরে অটল থাকার আদেশ দেন এবং বলেন, ‘অটল থাক ও উত্তম চরিত্র গঠন কর’। যার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর রাসূল (ছাঃ) ও ইসলামী বিধানের প্রতি অবিচল থাকবে এবং তাঁদের অবাধ্যতা হ’তে দূরে থাকবে।

ইসতিক্বামাত বা অটল থাকা দুই ধরনের। যথা-

১. হকের সাথে অটল থাকা।

২. সৃষ্টির সাথে অটল থাকা।

হকের সাথে অটল থাকার অর্থ হ’ল, আল্লাহর সাথে অটল থাকা। অর্থাৎ আল্লাহর অধিকার আদায়ে অবিচল ও দৃঢ় থাকা এবং তাঁর বিধান হ’তে কোন মতে পিছপা না হওয়া।

সৃষ্টির সাথে অটল থাকার অর্থ হ’ল, মানুষের অধিকার যা আল্লাহ তোমার উপর নির্ধারিত করেছেন তা সঠিকভাবে আদায় করা। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মু‘আয (রাঃ)-কে উপদেশ দেওয়ার সময় অটল থাকার উভয় প্রকারের আদেশ দেন। ‘দ্বীনে অটল থাক এবং উত্তম চরিত্র গঠন কর’। এখানে দু’টি বাক্য রয়েছে, প্রথমটি হ’ল, ‘দ্বীনের উপর অটল থাক’। এতে রয়েছে হকের সাথে অটল থাকার আদেশ। আর দ্বিতীয় বাক্যটি হচ্ছে ‘উত্তম চরিত্র গঠন কর’। আর এতে রয়েছে সৃষ্টির সাথে অবিচল থাকার আদেশ।[6]

ছাওবান (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল এরশাদ করেছেন, اسْتَقِيمُوْا وَلَنْ تُحْصُوْا وَاعْلَمُوْا أَنَّ خَيْرَ أَعْمَالِكُمُ الصَّلاَةُ وَلاَ يُحَافِظُ عَلَى الْوُضُوْءِ إِلاَّ مُؤْمِنٌ، ‘তোমরা সর্বদা আল্লাহর আনুগত্যে দৃঢ় থাক। যদিও (সকল বিষয়ে) যথার্থভাবে তোমরা সেটা কখনো পারবে না। জেনে রেখ তোমাদের সমস্ত নেক আমলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হ’ল ছালাত (অতএব কমপক্ষে সেটা যথাযথভাবে আদায়ে দৃঢ় থাক)। আর সর্বদা ওযূর হেফাযত করতে পারে না (অর্থাৎ সঠিকভাবে ওযূ করতে পারে না) মুসলিম ব্যতীত’।[7]

উপরোক্ত হাদীছে দু’টি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। এক. ‘তোমরা তা গণনাভুক্ত করতে পারো না’। দুই. তোমাদের সৎ আমল সমূহের মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে ছালাত’। তা গণনাভুক্ত করতে পারো না এর ব্যাখ্যা হ’ল-

১. দ্বীনে অটল থাকার প্রতিদান এত বড় এবং এত বেশী যে, তোমরা যদি তা গণনা করতে চাও তাহ’লে সক্ষম হবে না। কেননা তা তোমাদের ক্ষমতার বাইরে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমরা যদি আল্লাহর নে‘মতকে গণনা করতে চাও তাহ’লে তা পারবে না (ইব্রাহীম ১৪/৩৪)

২. দ্বীনে অটল থাকা খুবই শক্ত ও কঠিন কাজ। তাই তোমরা পুরোপুরিভাবে অটল থাকতে সক্ষম নও। এ কারণে তুমি সঠিক পথে থাক, সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক, কিন্তু তুমি পুরোপুরিভাবে তা করতে সক্ষম নও; বরং তোমার দ্বারা কিছু না কিছু ঘাটতি অবশ্যই সংঘটিত হবে। তাই আল্লাহ তোমাদের উপর রহম করেছেন এবং তোমাদের যতটুকু ক্ষমতা ততখানিই আল্লাহ হুকুম দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরা সাধ্যানুযায়ী আল্লাহকে ভয় কর’।[8]

তোমাদের সৎ আমলসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম আমল হচ্ছে ছালাত। বর্ণিত হাদীছগুলিতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) দ্বীনের উপর অটল থাকার সাথে সাথে ছালাতকে সর্বোত্তম আমল বলেছেন, যার কারণ হ’ল-

১. ইসতিক্বামাতের অর্থ হচ্ছে, দৃঢ়তার সাথে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য এবং ইসলামী বিধানসমূহের পাবন্দী করা এবং মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকা। মহান আল্লাহ ছালাতের ক্ষেত্রেও দৃঢ়তার আদেশ দেন। তিনি বলেন,اتْلُ مَا أُوْحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَذِكْرُ اللهِ أَكْبَرُ وَاللهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُوْنَ، ‘তুমি তোমার প্রতি ওহীকৃত কিতাব (কুরআন) পাঠ কর এবং ছালাত কায়েম কর। নিশ্চয়ই ছালাত যাবতীয় অশ্লীলতা ও গর্হিত কর্ম থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর স্মরণই হ’ল সবচেয়ে বড় বস্ত্ত। আল্লাহ জানেন যা কিছু তোমরা করে থাক’ (আনকাবূত ২৯/৪৫)।

২. প্রত্যেক ব্যক্তি যখন ছালাত আদায় করে তখন সে প্রত্যেক রাক‘আতে সূরা ফাতিহা পাঠ করার সময় ‘ইহদিনাছ ছিরাত্বাল মুসতাক্বীম’ বলার মাধ্যমে সঠিক পথ এবং দ্বীনে অটল থাকার প্রার্থনা করে। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘ছালাতকে অর্থাৎ সূরা ফাতিহাকে আমি আমার ও আমার বান্দার মধ্যে দু’ভাগে ভাগ করেছি। আর আমার বান্দা যা চাইবে তাই পাবে। যখন সে বলে, ‘আল-হামদুলিল্লাহ..’ তখন আল্লাহ বলেন, حَمِدَنِىْ عَبْدِىْ ‘আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে’। যখন সে বলে, ‘আর রহমা-নির রহীম’ তখন আল্লাহ বলেন, أَثْنَى عَلَىَّ عَبْدِىْ ‘আমার বান্দা আমার গুণ বর্ণনা করেছে’। যখন সে বলে, ‘মা-লিকি ইয়াওমিদ্দীন’ তখন আল্লাহ বলেন, مَجَّدَنِىْ عَبْدِىْ ‘বান্দা আমার মর্যাদা বর্ণনা করেছে’। যখন সে বলে, ‘ইয়্যাকা না‘বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাঈন’ তখন আল্লাহ বলেন, هَذَا بَيْنِىْ وَبَيْنَ عَبْدِىْ وَلِعَبْدِىْ مَا سَأَلَ ‘এটি আমার ও আমার বান্দার মধ্যে বিভক্ত। আর আমার বান্দা যা চাইবে, তাই পাবে’। অতঃপর যখন সে বলে, ‘ইহ্দিনাছ ছিরাত্বাল … ওয়াল লায্ যা-ল্লীন’ তখন আল্লাহ বলেন, هَذَا لِعَبْدِىْ وَلِعَبْدِىْ مَا سَأَلَ ‘এটি সম্পূর্ণ বান্দার জন্য। আর বান্দা যা চেয়েছে, তাই পাবে’।[9]

হাদীছটি অনুধাবন করুন, ‘এটা আমার বান্দার জন্য আর আমার বান্দা যা চেয়েছে তাই পাবে’। এ অংশে আল্লাহ বান্দার নিকট অঙ্গীকার করেছেন যে, সে যা চাইবে আমি তাকে তা দিব।

৩. অন্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) ছালাত সম্পর্কে বলেছেন, ছালাত হচ্ছে জ্যোতি-আলো।[10] যেমন অন্ধকারে মানুষ আলো দ্বারা নিজ রাস্তা এবং কাঙ্ক্ষিত বস্ত্ত দেখতে পায়, সেরূপ ছালাতের বরকতে আল্লাহ তা‘আলা মুছল্লীর অন্তরে ঈমানের আলো তৈরি করে দেন, যার মাধ্যমে তার জন্য হালাল ও হারাম, হিদায়াত ও ভ্রষ্টতা, জায়েয ও নাজায়েযের মধ্যে পার্থক্য করা সহজ হয়ে যায় এবং তার মধ্যে ছওয়াব ও হিদায়াতের প্রতি ভালবাসা এবং মন্দ ও ভ্রষ্টতার প্রতি শত্রুতা সৃষ্টি হয়।

৪. ছালাত সাধারণতঃ সকল সৎকাজের মূল। ছালাতে তেলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল, যিকর-আযকার, খুশূ-বিনম্রতা, বিনয়ী-অপারগতা ইত্যাদি গুণ বিদ্যমান থাকার কারণে তার জন্য শরী‘আতের বাস্তবায়ন এবং দ্বীনের উপর অটল থাকা সহজ হয়ে যায়।

দ্বীনের উপর অটল থাকার দো‘আ :

আলী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) আমাকে বলেন, তুমি বল,اللَّهُمَّ اهْدِنِىْ وَسَدِّدْنِىْ  ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে সুপথ প্রদর্শন কর এবং আমাকে সরল পথে পরিচালিত কর। আর তুমি সুপথের সংকল্প কর এবং সঠিক পথে স্থির থাক, যেভাবে তীর তার লক্ষ্যে স্থির থাকে।[11]

অর্থাৎ যেমন তোমরা কোথাও যাওয়ার সময় সঠিক পথ বেছে নিয়ে বাকী পথগুলি ছেড়ে দাও সেরূপ আল্লাহর নিকটে দ্বীনের সঠিক পথ তথা হিদায়াত এবং ছিরাতে মুসতাক্বীম কামনা কর। যেরূপ তুমি তীরকে সোজা ও বরাবর কর, যেন তা নিশানায় ঠিকভাবে লাগে, আর একটু বাঁকা হ’লে যেমন তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায় সেরূপ দ্বীনের উপর অটল থাক। তীর চালানোর পূর্বে যেমন তুমি সঠিকভাবে নিশানায় তীর চালাও ঠিক তদ্রূপ দ্বীনের উপর অটল থাকার জন্য এবং হকের উপর থাকার জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা কর। সামান্যতম মন্দ বা ভ্রষ্টতা যেন তোমার দ্বীনে প্রবেশ না করে।[12]

দ্বীনের উপর অবিচল ও সঠিক পথ অবলম্বনকারী মুসলিমের মর্যাদা :

আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আছ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলকে বলতে শুনেছি যে, إِنَّ الْمُسْلِمَ الْمُسَدَّدَ لَيُدْرِكُ دَرَجَةَ الصَوَّامِ الْقَوَّامِ بِآيَاتِ اللهِ بِحُسْنِ خُلُقِهِ وَكَرَمِ ضَرِيبَتِهِ، ‘দ্বীনের উপর অটল থাকা মুসলিম এবং সঠিক পথ অবলম্বনকারী মুসলিম নিজ সদ্ব্যবহার ও উত্তম চরিত্রের ফলে দিনব্যাপী ছাওম পালনকারী এবং রাতব্যাপী ক্বিয়ামকারী ব্যক্তির সমান ছওয়াব অর্জনকারী এবং সমমর্যাদাবান হ’তে সক্ষম’।[13]

অভাব-অনটন ও সমস্যার সময় দ্বীনের উপর অটল থাকা :

অভাব-অনটন, অসুস্থতা-দুর্বলতা, জান-মালের সমস্যা, ক্ষতি-লোকসান, শত্রুর ভয়-ভীতি, যুদ্ধ-অভিযান ইত্যাদি সময়ে অনেকে ইসতিক্বামাত, ইলাহী বিধান পালন, সুন্নাতে নববীর অনুসরণ এবং ধৈর্যধারণ করা ছেড়ে দেয়। অথচ এই সময়ই সত্য-মিথ্যা, খাঁটিঁ-ভেজাল এবং ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য নির্ণিত হয়।

এমন সময় ধৈর্যধারণকারী এবং ইসতিক্বামাত অবলম্বন- কারীদেরকে মহান আল্লাহ সত্য ও মুত্তাক্বী মুসলিম বলেছেন। তিনি বলেন,وَالصَّابِرِيْنَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِيْنَ الْبَأْسِ أُولَئِكَ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُوْنَ، ‘অভাবে, রোগ-পীড়ায় ও যুদ্ধের সময় যারা ধৈর্যের সাথে দৃঢ় থাকে, তারাই হ’ল সত্যাশ্রয়ী এবং তারাই হ’ল প্রকৃত আল্লাহভীরু’ (বাক্বারাহ ২/১৭৭)। কেননা এই তিন সময়ে অভাব, কষ্ট ও যুদ্ধের সময়ে ধৈর্য ধরা এবং আল্লাহর বিধান পালন করা হ’তে পিছপা না হওয়া খুবই কঠিন মুহূর্ত ও স্পর্শকাতর সময়। তাই মহান আল্লাহ বিশেষ করে এই অবস্থাসমূহের বর্ণনা দিয়েছেন।

ইসতিক্বামাত তথা দ্বীনের উপর অটল থাকার উপকরণ :

ইসতিক্বামাত দ্বীনের একটি বড় মর্যাদার নাম। যে মর্যাদা সম্মানিত নবীগণ অর্জন করেছিলেন এবং এই গুণে তাঁরা গুণান্বিত হয়েছিলেন। নবীগণের সাথে সাথে যারা তাদের পূর্ণ অনুসারী হয় তারাও সেই মর্যাদায় উন্নীত হন। এই মর্যাদা ও স্তর সব রকমের বাধা বিপত্তি পার করার পরেই অর্জিত হয়।

বলা যায়, সব ধরনের বাধা-বিপত্তি পার করে দ্বীনকে সংরক্ষিত রাখা এবং দ্বীনের উপর অটল থাকার নাম ইসতিক্বামাত। প্রতিবন্ধকতা শত্রুদের পক্ষ থেকে হয়, অনেক সময় আশেপাশের ঘটনাচক্র অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় নিজ নফস, নফসের কামনা-বাসনা, পরিবার-পরিজন এবং মাল-সম্পদের ভালবাসা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আর অনেক সময় কারো ভয় কিংবা আশা-আকাঙ্ক্ষা বাধা হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলার আদেশের উপর অটল থেকে এসব প্রতিবন্ধকতার উপর জয় লাভ করতে পারলেই বলা যেতে পারে যে, অমুক ব্যক্তি ইসতিক্বামাতের অধিকারী।[14]

ইসতিক্বামাত তথা দ্বীনের উপর অটল থাকার বাহ্যত কিছু কারণ রয়েছে, যার পরিপূর্ণ বিবরণ কষ্টসাধ্য। তন্মধ্যে ছয়টি উপকরণের বর্ণনা দেয়া যরূরী মনে করছি। সেগুলো নিম্নে প্রদত্ত হ’ল :

১. দো‘আ করা : প্রত্যেক মুমিন পুরুষ ও মুমিনা নারীর জন্য উচিৎ, তারা যেন দ্বীনের উপর অটল থাকার জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করে। কারণ সবকিছুর দাতা মহান আল্লাহ। এ কারণে কুরআন ও সুন্নাতে অধিকহারে ইসতিক্বামাতের দো‘আর তাকীদ এসেছে, যার কিছুটা নিম্নরূপ:

ক. সূরা ফাতিহা যাকে উম্মুল কুরআন বলা হয়। প্রত্যেক মুছল্লীকে প্রত্যেক ছালাতে যা পাঠ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। তাতে ইসতিক্বামাতের দো‘আ এভাবে করতে বলা হয়েছে।اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ، صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ ‘তুমি আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন কর! এমন লোকদের পথ, যাদেরকে তুমি পুরস্কৃত করেছ’ (সূরা ফাতিহা ১/৬-৭)

খ. সূরা আলে ইমরানে ইসতিক্বামাতের দো‘আ এভাবে বর্ণিত হয়েছে,رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوْبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ، ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদেরকে সুপথ প্রদর্শনের পর আমাদের অন্তর সমূহকে বক্র কর না। আর তুমি আমাদেরকে তোমার পক্ষ হ’তে বিশেষ অনুগ্রহ প্রদান কর। নিশ্চয়ই তুমি সর্বাধিক দানকারী’ (আলে ইমরান ৩/৮)।

গ. আলী (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাকে আদেশ দিয়েছেন, আমি যেন এই দো‘আটি পাঠ করি,اللَّهُمَّ اهْدِنِى وَسَدِّدْنِى ‘হে আল্লাহ! আমাকে হিদায়াত দাও এবং অটল রাখ’।

আলী (রাঃ) আরো বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাকে যখন এই দো‘আ করতে বলেন, তখন সোজা পথ হ’তে রাস্তার সোজা এবং সঠিক বলতে তীর নিক্ষেপের সঠিকতার ধারণা করার আদেশ দেন। অর্থাৎ যেমন কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা হ’লে সোজা দিকেই যাও, এদিক-ওদিক, ডান-বামে যেও না সেরূপ আল্লাহর নিকট হেদায়াত প্রার্থনা করার সময় সঠিক রাস্তার খেয়াল করা যরূরী। যেন গন্তব্য স্থলে পৌঁছানো সম্ভব হয় এবং শরী‘আতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা যায়। অন্ধকার ও ভ্রষ্টতা, বিদ‘আত ও খুরাফাতের দিকে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা না থাকে। এই সোজা পথের আবেদনের সময় তীরের সোজা নিশানার খেয়াল রাখা প্রয়োজন। যেমন তীর সঠিক নিশানায় গিয়ে লাগে ডানে বামে যায় না, ঠিক তেমন ইলম ও আমলে সঠিকতার খেয়াল রাখা প্রয়োজন যেন তাতে অসত্য প্রবেশ না করতে পারে।

ঘ. আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) এভাবে দো‘আ করতেন,اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ الْهُدَى وَالتُّقَى وَالْعَفَافَ وَالْغِنَى ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকটে সুপথের নির্দেশনা, পরহেযগারিতা, পবিত্রতা ও সচ্ছলতা প্রার্থনা করছি’।[15]

২. আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা :

সবসময় আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করলে এবং তাঁর নিকট হেদায়াত প্রার্থনা করলে ইসতিক্বামাত অর্জিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّيْنِ مَا وَصَّى بِهِ نُوْحًا وَالَّذِيْ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيْمَ وَمُوْسَى وَعِيْسَى أَنْ أَقِيْمُوْا الدِّيْنَ وَلَا تَتَفَرَّقُوْا فِيْهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِيْنَ مَا تَدْعُوْهُمْ إِلَيْهِ اللهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيْبُ، ‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন যে নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন, আর যা আমি তোমার কাছে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম- তা হল: তোমরা দ্বীন কায়েম করবে এবং এতে বিভক্তি করো না। তুমি মুশরিকদেরকে যেদিকে আহবান করছ তা তাদের কাছে কঠিন মনে হয়; আল্লাহ যাকে চান দ্বীনের দিকে নিয়ে আসেন। আর যে তাঁর অভিমুখী হয় তাকে তিনি  হেদায়াত দান করেন’ (শূরা ৪২/১৩)।

এই আয়াতের শেষাংশে মহান আল্লাহ স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি তাঁর দ্বীন গ্রহণ করার, সমস্ত ইবাদত তাঁর উদ্দেশ্যে একনিষ্ঠভাবে করার এবং দ্বীনের উপর অটল থাকার সুমতি ঐ ব্যক্তিকে দান করেন, যে তাঁর ইবাদত ও আনুগত্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করে।

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِيْنَ، ‘পক্ষান্তরে যারা আমাদের পথে জিহাদ করে তথা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমরা আমাদের পথ সমূহের দিকে পরিচালিত করব। আর আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মশীলদের সাথে থাকেন’ (আনকাবূত ২৯/৬৯)।

যারা আমার রাস্তায় সর্বদা সংগ্রাম করে, সদা এই চিন্তায় থাকে যে কিভাবে আমাকে খুশী করবে, আমার সন্তুষ্টির চিন্তায় থাকে, তাহ’লে আমিও তাকে আমার সন্তুষ্টির রাস্তা দেখিয়ে দেই। অর্থাৎ আমার তাওফীক তার সাথে সবসময় থাকে। তার অন্তরে আমার স্মরণ দৃঢ়রূপে থাকে; বরং ধীরে ধীরে তা বৃদ্ধি পায়। আর এসবের অর্থ হচ্ছে যে, আমি নেক বান্দাদের সাথে থাকি আর তাদের নেক তাওফীক দান করি।[16]

অনুরূপ হাদীছে কুদসীতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার নিকট একটি ভাল কাজ নিয়ে উপস্থিত হবে, তার জন্য তার দশগুণ পুরষ্কার আছে। আমি তার চেয়েও বেশী দিব। আর যে একটি মন্দ কাজ নিয়ে উপস্থিত হবে তার প্রতিফল তার অনুরূপ একগুণ আছে। অথবা আমি ক্ষমা করে দিব। যে আমার এক বিঘত নিকটে আসে আমি তার এক হাত নিকটে যাই। আর যে আমার এক হাত নিকটে আসে আমি তার দু’হাত নিকটে হই। আর যে আমার নিকট হেঁটে আসে আমি তার নিকটে দৌঁড়িয়ে যাই। যে আমার নিকটে পৃথিবী পূর্ণ গুনাহ নিয়ে আসে আমার সাথে কাউকে শরীক না করে আমি তার সাথে সাক্ষাত করি ঐ পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে’।[17]

৩. আল্লাহর ইবাদতে একনিষ্ঠতা বজায় রাখা :

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর খাঁটিঁ বান্দাকে এবং যাকে তিনি একান্ত বান্দা বানিয়ে নেন তাকে সব ধরনের মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখেন এবং তাকে দ্বীনের উপর অবিচল রাখেন। নবী ইউসুফ (আঃ) সম্পর্কে মহান আল্লাহ উল্লেখ করেছেন,وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا لَوْلَا أَنْ رَأَى بُرْهَانَ رَبِّهِ كَذَلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوْءَ وَالْفَحْشَاءَ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِيْنَ، ‘উক্ত মহিলা তার বিষয়ে কুচিন্তা করেছিল এবং সেও তার প্রতি কল্পনা করত যদি না সে স্বীয় পালনকর্তার প্রমাণ অবলোকন করত। এভাবেই এটা এ কারণে যাতে আমরা তার থেকে যাবতীয় মন্দ ও অশ্লীল বিষয় সমূহ সরিয়ে দেই। নিশ্চয়ই সে ছিল আমাদের মনোনীত বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত’ (ইউসুফ ১২/২৪)।

তাফসীরে সানাঈতে উল্লেখিত হয়েছে, কেননা ইউসুফ আমার খাঁটিঁ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর আমার বিশেষ রহমতের দাবী হচ্ছে, আমার খাছ বান্দাদের অবস্থা ও আচরণ সুন্দর হবে। যদি মানুষ হিসাবে কখনও তাদের ভুল হওয়ার উপক্রম হয় তাহ’লে আমি যেন তাদের তা থেকে বিরত রাখি।[18]

৪. প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহকে ভয় করা :

প্রকাশ্যে ও গোপনে সবসময় এবং সর্বস্থানে অন্তরে আল্লাহর ভয় পোষণ করা। কারণ এর মাধ্যমেই ব্যক্তি নিজেকে পাপ থেকে দূরে রাখে এবং সৎকাজে অগ্রসর হয়। তাকওয়া তথা আল্লাহভীরুতার উপর সৎ কাজ নির্ভরশীল। আবু যর গিফারী (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,أُوصِيْكَ بِتَقْوَى اللهِ فَإِنَّهُ رَأْسُ كُلِّ شَىْءٍ وَعَلَيْكَ بِالْجِهَادِ فَإِنَّهُ رَهْبَانِيَّةُ الإِسْلاَمِ وَعَلَيْكَ بِذِكْرِ اللهِ وَتِلاَوَةِ الْقُرْآنِ فَإِنَّهُ رَوْحُكَ فِى السَّمَاءِ وَذِكْرٌ لَكَ فِى الأَرْضِ، ‘তোমাকে আমি আল্লাহভীরুতার উপদেশ দিচ্ছি, কারণ তা সবকিছুর মূল। তুমি জিহাদ করবে, কারণ তা ইসলামের বৈরাগ্য। আর তুমি অবশ্যই আল্লাহর যিকর এবং কুরআন তেলাওয়াত করতে থাকবে। কারণ তা হচ্ছে আসমানে তোমার আত্মার প্রশান্তি স্বরূপ এবং যমীনে তোমার স্মরণ স্বরূপ’।[19] উক্ত হাদীছে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীরুতাকে সবকিছুর মূল তথা ভিত্তি বলা হয়েছে।

এটা প্রজ্ঞার মূল। আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) তার খুৎবায় বর্ণনা করতেন, ‘সর্বোত্তম পারিতোষিক হচ্ছে আল্লাহভীরুতা এবং প্রজ্ঞা ও হেকমতের মূল হচ্ছে আল্লাহভীতি’।[20]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামের তাক্বওয়া বৃদ্ধির জন্য যেভাবে দো‘আ করতেন :

আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুব কমই কোন মজলিস থেকে উঠতেন যতক্ষণ না তার ছাহাবীদের জন্য এই দো‘আ করতেন যে,

اللَّهُمَّ اقْسِمْ لَنَا مِنْ خَشْيَتِكَ مَا يَحُوْلُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مَعَاصِيكَ وَمِنْ طَاعَتِكَ مَا تُبَلِّغُنَا بِهِ جَنَّتَكَ وَمِنَ الْيَقِيْنِ مَا تُهَوِّنُ بِهِ عَلَيْنَا مُصِيْبَاتِ الدُّنْيَا وَمَتِّعْنَا بِأَسْمَاعِنَا وَأَبْصَارِنَا وَقُوَّتِنَا مَا أَحْيَيْتَنَا وَاجْعَلْهُ الْوَارِثَ مِنَّا وَاجْعَلْ ثَأْرَنَا عَلَى مَنْ ظَلَمَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى مَنْ عَادَانَا وَلاَ تَجْعَلْ مُصِيْبَتَنَا فِىْ دِيْنِنَا وَلاَ تَجْعَلِ الدُّنْيَا أَكْبَرَ هَمِّنَا وَلاَ مَبْلَغَ عِلْمِنَا وَلاَ تُسَلِّطْ عَلَيْنَا مَنْ لاَ يَرْحَمُنَا-

‘হে আল্লাহ! আমাদের মাঝে তুমি এতো পরিমাণ আল্লাহভীতি ভাগ কর যা আমাদের মাঝে ও তোমার প্রতি অবাধ্য হওয়ার মাঝে বাধা হ’তে পারে। আর আমাদের মাঝে তোমার প্রতি আনুগত্য এত পরিমাণ প্রদান কর, যার দ্বারা তুমি আমাদেরকে তোমার জান্নাতে পৌঁছে দিবে। এতটা দৃঢ় প্রত্যয় প্রদান কর, যার মাধ্যমে তুমি পৃথিবীর যে কোন কষ্ট আমাদের জন্য সহজসাধ্য করবে। যতক্ষণ আমাদের তুমি জীবিত রাখো, ততক্ষণ আমাদের কর্ণ, আমাদের চক্ষু ও আমাদের শক্তি-সামর্থ্য দিয়ে আমাদের জীবনের উপকরণ দান কর (কিংবা আমাদের চোখ-কান মৃত্যু পর্যন্ত সতেজ ও সুস্থ রাখো)। আর তাকে আমাদের উত্তরাধিকার বানিয়ে দাও। আমাদের উপর যে অত্যাচার করে তার প্রতি আমাদের প্রতিশোধ সুনির্ধারিত করো, আমাদের প্রতি যে দুশমনী করে তার বিরুদ্ধে আমাদেরকে সহযোগিতা কর, আমাদের ধর্ম পালনে আমাদের বিপদগ্রস্ত কর না, দুনিয়া অর্জনকে আমাদের ও আমাদের জ্ঞানের উদ্দেশ্যে রূপান্তর করো না এবং আমাদের প্রতি যে দয়া করবে না তাকে আমাদের উপর প্রভাবশালী (শাসক নিয়োগ) কর না’।[21]

উক্ত দো‘আয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বর্ণিত হয়েছে। যথা-

আল্লাহভীরুতার ফযীলত, কেননা তা বান্দা এবং বান্দার পাপের মাঝে অন্তরায় হয়। সে কারণে যে বান্দা যত বেশী পাপ করে সে তত বেশী আল্লাহভীরুতা হ’তে মাহরূম হয়ে যায়। পাপ থেকে বিরত থাকাই সত্যিকারের তাক্বওয়া তথা আল্লাহভীরুতা। আর এটা খুবই সুন্দর বস্ত্ত এবং আল্লাহ প্রদত্ত বড় নে‘মত। আল্লাহর রাসূল প্রায়ই তাঁর সাথীদের জন্য আল্লাহভীরুতার দো‘আ করতেন।

এখানে দৃঢ় বিশ্বাসেরও ফযীলত প্রমাণিত হয়, কারণ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, ইয়াকীনের মাধ্যমে বালা-মুছীবত সহজ হয়ে যায়। এটা এভাবে যে, যখন মানুষের মধ্যে এই দৃঢ় বিশ্বাস জন্ম নেয় যে, তাকে এক দিন না এক দিন মরতেই হবে এবং কষ্টের এই জগৎ ছেড়ে যেতেই হবে, তখন তার জন্য সমস্ত কষ্ট সহজ হয়ে যায়। আর যার মধ্যে এই দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, ইবাদত ও ইতা‘আতের বদলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে প্রচুর বিনিময় দান করবেন, তাহ’লে তার জন্য কঠিন কাজ সহজ হয়ে যায়। অনুরূপ যার মধ্যে এই দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, মুছীবতের সময় ধৈর্যধারণকারীর বদলা অপরিসীম এবং তিনি ধৈর্যশীলদের সাহায্য করেন, তখন তাকে স্বয়ং বালা-মুছীবত আনন্দদায়ক মনে হয়। এভাবে যখন তার মধ্যে আল্লাহর শাস্তি, কবরের শাস্তি এবং ক্বিয়ামতের শাস্তির বিশ্বাস দৃঢ় হয়, তখন পাপ বর্জন করা এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ না করা সহজ হয়ে যায়। ফলকথা ঈমান তথা দৃঢ় বিশ্বাস সমাধান ও সহজের চাবি-কাঠি।

‘আমাদের ধর্ম পালনে আমাদের বিপদগ্রস্ত করো না’ দো‘আর এই অংশে দুই ধরনের মুছীবতের কথা বলা হয়েছে।

প্রথমটি হ’ল, দুনিয়ার মুছীবত যেমন দরিদ্রতা, দুঃখ-কষ্ট, অসুস্থতা ইত্যদি। দ্বিতীয়টি হ’ল দ্বীনের মুছীবত, যেমন বিদ‘আতী, ফাসেক, পাপিষ্ঠ, ব্যাভিচারী ও নর্তকীদের সংস্পর্শ। কেননা এর ফলে ব্যক্তির পরকালের জীবন নষ্ট হয়ে যায়, তার দ্বীনে ঘাটতি হয় এবং ছওয়াবের আশা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। উক্ত কারণে তিনি তা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন।

পার্থিব জীবনের নিন্দা : কেননা নবী করীম (ছাঃ) তাঁর দো‘আয় বলেন, ‘দুনিয়ার্জনকে আমাদের জীবনের বড় উদ্দেশ্য করো না’। এ কারণে যে, দুনিয়া অভিশপ্ত এবং অভিশপ্ত অন্বেষীও। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, পৃথিবী অভিশপ্ত এবং তাতে যা আছে তাও অভিশপ্ত। কিন্তু আল্লাহর স্মরণ এবং যে তাকে ভালবাসে কিংবা যে জ্ঞানী কিংবা জ্ঞান অর্জনকারী’।[22]

তাক্বওয়া তথা আল্লাহভীরুতার উপদেশ :

কুরআন ও হাদীছে তাক্বওয়া অর্জনের অনেক উপদেশ প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সফর এবং মুক্বীম উভয় অবস্থাতে তাঁর ছাহাবীদের তাক্বওয়ার উপদেশ দিতেন।

১. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلَقَدْ وَصَّيْنَا الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَإِيَّاكُمْ أَنِ اتَّقُوا اللهَ، ‘বস্ত্ততঃ আমরা আদেশ করেছিলাম তোমাদের পূর্ববর্তী কিতাবধারীদের এবং তোমাদের এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর’ (নিসা ৪/১৩১)।

২. ছাহাবী আবু যর গিফারী (রাঃ)-কে আল্লাহর রাসূল উপদেশ দেন যে, اتَّقِ اللهَ حَيْثُمَا كُنْتَ وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ، ‘যেখানেই অবস্থান করো না কেন আল্লাহকে ভয় করো এবং পাপের পরে নেকী কর। নেকী তা মুছে দিবে। আর মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার কর’।[23]

৩. ছাহাবী আনাস বিন মালিক (রাঃ) বলেন, একদা জনৈক ব্যক্তি আললাহর রাসূলের খিদমতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহ রাসূল (ছাঃ)! আমি সফরে বের হওয়ার ইচ্ছা করেছি কিন্তু আমার নিকটে পাথেয় নেই। তাই পাথেয়র ব্যবস্থা করে দিন। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, زَوَّدَكَ اللهُ التَّقْوَى ‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে তাক্বওয়ার পাথেয় দান করুন’। ছাহাবী এটা শুনে দারুণ আনন্দিত হয় এবং আরো অধিক উপদেশ কামনা করে। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَغَفَرَ ذَنْبَكَ ‘আল্লাহ তা‘আলা তোমার গুনাহ মাফ করে দিন’। ছাহাবী বলল, আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার প্রতি কুরবান হোক আরও উপদেশ দিন। তিনি বললেন, وَيَسَّرَ لَكَ الْخَيْرَ حَيْثُمَا كُنْتَ، ‘তুমি যেখানেই অবস্থান করো না কেন আল্লাহ তোমার জন্য নেকী অর্জনের পথ সহজ করে দিন’।[24]

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, আমি ভ্রমণে যাচ্ছি তাই আমাকে কিছু উপদেশ দিন। তখন আল্লাহর রাসূল বললেন, عَلَيْكَ بِتَقْوَى اللهِ وَالتَّكْبِيْرِ عَلَى كُلِّ شَرَفٍ،  ‘তোমার উপর যরূরী যে, তুমি আল্লাহকে ভয় করবে এবং প্রত্যেক উঁচু স্থানে তাকবীর বলবে। যখন সেই ব্যক্তি যেতে লাগল তখন আল্লাহর রাসূল তার জন্য দো‘আ করে বললেন,اللَّهُمَّ اطْوِ لَهُ الأَرْضَ وَهَوِّنْ عَلَيْهِ السَّفَرَ، ‘হে আল্লাহ! তার জন্য দূরত্ব কম করে দাও এবং তার জন্য সফর সহজ করে দাও’।[25]

দ্বীনের পথে চলার সময় তাক্বওয়া দ্বারা জ্যোতি অর্জিত হয় :

আল্লাহ রাববুল আলামীন এরশাদ করেন,يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اتَّقُوا اللهَ وَآمِنُوْا بِرَسُوْلِهِ يُؤْتِكُمْ كِفْلَيْنِ مِنْ رَحْمَتِهِ وَيَجْعَلْ لَكُمْ نُوْرًا تَمْشُوْنَ بِهِ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ، ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন কর। তিনি স্বীয় অনুগ্রহে তোমাদেরকে দ্বিগুণ পুরস্কার দিবেন। আর তিনি তোমাদেরকে দিবেন ‘জ্যোতি’। যার সাহায্যে তোমরা চলবে এবং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (হাদীদ ৫৭/২৮)।

তাক্বওয়ার মাধ্যমে মুমিনের অন্তরে হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করার শক্তি তৈরি হয় :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِنْ تَتَّقُوْا اللهَ يَجْعَلْ لَكُمْ فُرْقَانًا وَيُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيْمِ، ‘হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহভীরু হও, তাহ’লে তিনি তোমাদের জন্য সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করার পথ বের করে দিবেন এবং এর ফলে তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন ও তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ হ’লেন মহা অনুগ্রহশীল’ (আনফাল ৮/২৯)।

এই আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, যে দল আল্লাহভীরু হবে তার মধ্যে সত্য-অসত্য এবং ভাল ও মন্দের মাঝে পার্থক্য করার একটি বিশেষ শক্তি সৃষ্টি হবে। যে কারণে সে বাতিল ও মন্দের দিকে কখনো পা পাড়াবে না। তাই পৃথিবীবাসী স্বর্ণ যুগের মুসলিমদের অবস্থা দেখেছে, তারা কেমন ছিল। আরবের মরুবাসী যাদের সমস্ত জীবন উট-ছাগলের দেখা-শুনা করতে অতিবাহিত হ’ত, তারা হঠাৎ কিভাবে রোম ও পারস্যের মত সভ্য সম্প্রদায়ের উপর জয় লাভ করে? ভাল-মন্দ পার্থক্য করার এমন শক্তি তাদের মধ্যে চলে আসে যে, তারা যা কিছুই করত তা সত্য, ন্যায়, কল্যাণ ও সৌভাগ্য ছাড়া কিছুই হ’ত না।

৫. নিয়মিত ছালাত সম্পাদন করা :

সঠিক সময়ে ছালাত সম্পাদন এবং তা সুন্নাত অনুযায়ী আদায় করাও দ্বীনের উপর অটল থাকার একটি বড় উপকরণ। কারণ নবী করীম (ছাঃ) ছালাত সম্পর্কে বলেছেন, ‘ছালাত হচ্ছে জ্যোতি’ অর্থাৎ আলো।[26]

১. ছালাতের বরকতে মুমিনের অন্তরে আলো তৈরী হয়, যার মাধ্যমে  তার  বক্ষ  প্রশস্ত  করে  দেওয়া হয়, যার ফলে তার অন্তর সত্যকে ভালবাসতে থাকে এবং তা গ্রহণ করে। আর প্রত্যেক মন্দের বিষয়ে তার অন্তরে ঘৃণা সৃষ্টি হয় এবং তা থেকে সে সুরক্ষিত থাকে।

২. ছালাত মুছল্লীকে মন্দ, নির্লজ্জতা এবং নোংরামী হ’তে দূরে রাখে এবং ছওয়াব ও কল্যাণের পথ দেখায়। মানুষ যেমন আলোতে লাভজনক বস্ত্তকে নিয়ে নেয় এবং কষ্টদায়ক বস্ত্ত হ’তে নিজেকে হেফাযতে রাখে। তদ্রূপ ছালাত মুছল্লীকে হারাম, অবৈধ এবং অশ্লীলতা থেকে নিরাপদে রাখে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের প্রতি সুদৃঢ় রাখে। একারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَذِكْرُ اللهِ أَكْبَرُ وَاللهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُوْنَ، ‘তুমি তোমার প্রতি ওহীকৃত কিতাব (কুরআন) পাঠ কর এবং ছালাত কায়েম কর। নিশ্চয়ই ছালাত যাবতীয় অশ্লীলতা ও গর্হিত কর্ম থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর স্মরণই হ’ল সবচেয়ে বড় বস্ত্ত। আল্লাহ জানেন যা কিছু তোমরা করে থাক’ (আনকাবূত ২৯/৪৫)।

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একদা এক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল,إِنَّ فُلاَناً يُصَلِّى بِاللَّيْلِ فَإِذَا أَصْبَحَ سَرَقَ، ‘অমুক ব্যক্তি রাতে ছালাত আদায় করে আর সকাল হ’লে চুরি করে। তখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বললেন, إِنَّهُ سَيَنْهَاهُ مَا تَقُولُ، ‘অচিরে তার ছালাত তাকে ঐ বিষয় থেকে বিরত রাখবে, যা তুমি বলছ’।[27]

৬. ধৈর্যধারণ করা :

ইহ-পরকালীন সকল বিষয়ে ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাওয়ার হুকুম প্রদান করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اسْتَعِينُوْا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ إِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِيْنَ، ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/১৫৩)। অনুরূপ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ)-কে আদেশ করেন, ‘জেনে রেখো অবশ্যই সাহায্য ধৈর্যের সাথে রয়েছে’।

ইসতিক্বামাত তথা দ্বীনের উপর অটল থাকার ব্যাপারে ধৈর্য বিশেষ গুরুত্ব রাখে। ছাহাবায়ে কেরাম যে ঈমান ও আমলের ক্ষেত্রে দ্বীনের উপর অটল থাকতে সক্ষম হয়েছিলেন, তার বড় কারণ ছিল ধৈর্য। ওমর বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, وَجَدْنَا خَيْرَ عَيْشِنَا بِالصَّبْرِ ‘আমাদের জীবনের কল্যাণ পেয়েছিলাম ধৈর্যের মাধ্যমে’।[28]

আলী বিন আবী ত্বালিবকে একদা কেউ জিজ্ঞেস করল, হে আমীরুল মুমিনীন! ঈমান কাকে বলে? তিনি উত্তরে বললেন, الْإِيْمَانُ عَلَى أَرْبَعِ دَعَائِمَ : عَلَى الصَّبْرِ، وَالْعَدْلِ، وَالْيَقِيْنِ، وَالْجِهَادِ، ‘ঈমান চারটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। (১) ধৈর্য (২) ন্যায়পরায়ণতা (৩) দৃঢ় বিশ্বাস (৪) জিহাদ’।[29]

আলী (রাঃ) বলেন, ধৈর্যের সম্পর্ক ঈমানের সাথে তেমন, যেমন শরীরের সাথে মাথার সম্পর্ক। যদি মস্তিষ্ক কেটে দেওয়া হয় তাহ’লে শরীর অকেজো হয়ে যায়। ঠিক সেভাবে যদি ধৈর্য শেষ হয়ে যায়, তাহ’লে ঈমানও শেষ হয়ে যায়।[30]

মহান আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اصْبِرُوْا وَصَابِرُوْا وَرَابِطُوْا وَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ، ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ধৈর্যধারণ কর। পরস্পরে দৃঢ় থাক এবং সদা প্রস্ত্তত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (আলে ইমরান ৩/২০০)।

ধৈর্য আল্লাহ তা‘আলার সবচেয়ে বড় দান :

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা আনছার ছাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত কিছু ছাহাবী আল্লাহর রাসূলের নিকটে এসে কিছু চাইলে তিনি তাদের তা প্রদান করলেন। তারা দ্বিতীয়বারে চাইলে তিনি আবার দিলেন। এমনকি তাঁর নিকট যত সম্পদ ছিল সব শেষ হয়ে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ বললেন,مَا يَكُونُ عِنْدِى مِنْ خَيْرٍ فَلَنْ أَدَّخِرَهُ عَنْكُمْ، وَمَنْ يَسْتَعْفِفْ يُعِفَّهُ اللهُ، وَمَنْ يَسْتَغْنِ يُغْنِهِ اللهُ، وَمَنْ يَتَصَبَّرْ يُصَبِّرْهُ اللهُ، وَمَا أُعْطِىَ أَحَدٌ عَطَاءً خَيْرًا وَأَوْسَعَ مِنَ الصَّبْرِ، ‘আমার নিকটে যত মাল-সম্পদ জমা হবে আমি সব তোমাদের মাঝে বণ্টন করে দিব কিছুই অবশিষ্ট রাখব না। কিন্তু অবশ্যই মনে রাখবে, যে ব্যক্তি চাওয়া থেকে বাঁচতে চায় আল্লাহ তাকে বাঁচাবেন। আর যে ধনী হ’তে চায় আল্লাহ তাকে ধনবান করে দিবেন। আর যে ধৈর্যধারণের চেষ্টা করবে আল্লাহ তাকে ধৈর্যধারণের সুমতি দিবেন। ধৈর্য ব্যতীত মহান ও বড় নে‘মত আল্লাহ কাউকে অন্য কিছু প্রদান করেননি’।[31]

পরিশেষে বলব, ইস্তিক্বামাত দ্বারা মানুষের ইহকাল ও পরকাল মঙ্গলময় হবে। পার্থিব জীবনের সব কাজ সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পাদিত হবে। সেই সাথে আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের কাজ করতে সচেষ্ট হবে। জান্নাতী আমল করতে উৎসাহিত হবে। ফলে পরকালে নাজাত লাভ করা এবং জান্নাতে যাওয়া সহজ হবে। তাই আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে ইস্তিক্বামাত তথা দ্বীনের উপরে অবিচল থাকার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

– আব্দুর রাক্বীব মাদানী
শিক্ষক, জামে‘আতুল ইমাম আল-বুখারী, কিষাণগঞ্জ, বিহার, ভারত


[1]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা হা-মীম সাজদা ৩০ আয়াত।[2]. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, কিতাবুয যুহদ, পৃঃ ১০৯।

[3]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা হা-মীম সাজদা ৩০ আয়াত।

[4]. ঐ।

[5]. ইবনু হিববান হা/৪৭৪; হাকেম হা/১৭৯; ত্বাবারানী, কাবীর হা/৫৮; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১২২৮।

[6]. ফয়যুল ক্বাদীর ১/৪৯৭।

[7]. ইবনু মাজাহ হা/২৭৭, মিশকাত হা/২৯২।

[8]. ফায়যুল ক্বাদীর ১/৪৯৭।

[9]. মুসলিম হা/৩৯৫, নাসাঈ, মিশকাত হা/৮২৩।

[10]. মুসলিম হা/২২৩; মিশকাত হা/২৮১।

[11]. মুসলিম হা/২৭২৫; মিশকাত হা/২৪৮৫।

[12]. নববী, শরহ মুসলিম ৯/৫২; মির‘আতুল মাফাতীহ ৬/১৩৯।

[13]. আহমাদ হা/৬৬৪৮; ছহীহাহ হা/৫২২।

[14]. ওয়াযিহুল বায়ান ফী তাফসীরে উম্মুল কুরআন, পৃঃ ২৪৯-৫০।

[15]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৪৮৪।

[16]. তাফসীরে সানাঈ, পৃ: ৪৮৪।

[17]. মুসলিম হা/২৬৮৭, মিশকাত হা/২২৬৫।

[18]. তাফসীরে সানাঈ, পৃ. ২৮৪।

[19]. আহমাদ হা/১১৭৯১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫৫৫।

[20]. শু‘আবুল ঈমান হা/৭২৮; সিলসিলা যঈফাহ হা/২০৫৯, সনদ মওকূফ হাসান।

[21]. তিরমিযী হা/৩৫০২, সনদ হাসান।

[22]. ইবনু মাজাহ হা/৪১১২; আবু দাঊদ হা/২১৬২; তিরমিযী হা/২৩২২; মিশকাত হা/৫১৭৬।

[23]. তিরমিযী হা/১৯৮৭, মিশকাত হা/৫০৮৩, সনদ হাসান।

[24]. তিরমিযী হা/৩৪৪৪, মিশকাত হা/২৪৩৭, সনদ হাসান ছহীহ।

[25]. তিরমিযী হা/৩৪৪৫, মিশকাত হা/২৪৩৮, সনদ হাসান।

[26]. ছহীহুল জামে‘ হা/৯২৫।

[27]. আহমাদ হা/৯৭৭৭, মিশকাত হা/১২৩৭, ছহীহাহ হা/৩৪৮২।

[28]. বুখারী, ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, ‘আল্লাহর নিষেধাজ্ঞার প্রতি ধৈর্যধারণ করা’ অনুচ্ছেদ।

[29]. শুআবুল ঈমান ১/১৮২; লালাকাঈ শারহুস সুন্নাহ ২/৮২২-৮২৩।

[30]. শু‘আবুল ঈমান হা/৩৮; শারহুস সুন্নাহ ২/৮২২।

[31]. বুখারী হা/৬৪৭০, মিশকাত হা/১৮৪৪।

Jahirul.Islam

Share
Published by
Jahirul.Islam

Recent Posts

How Much Does It Cost to Build a Barndominium in 2025

If you're thinking about building a barndominium in 2025, you're not alone. These barn-style homes…

5 days ago

How Long Does It Take to Charge a Car Battery

A dead or drained car battery can be a frustrating issue, especially when you're in…

6 days ago

How Can I Plan a Trip to PR by Myself

Dreaming of a tropical escape but want to explore on your own terms? If you’ve…

6 days ago

How to Teach My Four Year Old to Share

Teaching your child to share is one of the most valuable lessons they’ll learn in…

6 days ago

How to Dispose of Old Gasoline Safely and Legally

Old gasoline sitting in your garage or shed can pose serious risks to your health,…

6 days ago

How to Date an Entity Hentai

If you’re a fan of anime and are curious about the stranger, more supernatural side…

6 days ago