বারযাখী জীবন সম্পর্কে কতগুলো মাসআলা

প্রথম মাসআলা

এ উম্মতের পূর্বলোক (সালাফ) এবং ইমামদের মাযহাব হলো, যখন কোনো ব্যক্তি মারা যায় তখন সে তার ঈমান ও আমল অনুযায়ী শান্তি বা শাস্তিতে থাকে। আর তা শরীর এবং রূহ উভয়েরই ঘটবে।

রূহ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর তা হয় শান্তিপ্রাপ্ত না হয় সাজাপ্রাপ্ত হবে। কখনো অল্প সময়ের জন্য সাজা দিয়ে তা শান্তিতে পরিণত করে দেওয়া হবে যদি সে পাপ হতে পবিত্র হয়ে যায়। কখনো রূহ শরীরের সাথে মিলিত হলে তখন শরীরের সাথে রূহেরও শান্তি বা শাস্তি ভোগ করতে হবে। সুতরাং কবর হয় জান্নাতের বাগিচা না হয় জাহান্নামের গুহা। যে কেউ মারা যাওয়ার পর যদি শাস্তি বা শান্তির হকদার হয়, তবে সে তার পুরোপুরি অংশ পাবে, তাকে কবর দেওয়া হোক বা না হোক।

আল্লাহ তা‘আলাই স্রষ্টা, উদ্ভাবক এবং প্রত্যেক জিনিসের ওপর ক্ষমতাবান। অতঃপর যখন মহা প্রলয়ের দিন আসবে তখন রূহ শরীরে ফিরিয়ে দেওয়া হলে তারা তাদের কবর থেকে তাদের রবকে হিসাব দেওয়ার জন্য এবং প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য উঠে দাঁড়াবে।[1]

দ্বিতীয় মাসআলা

আল্লাহ আমাদের এবং আপনাদের সকলকে রহমত করুন, জেনে রাখুন! কবরের কঠোরতা ও বালা-মুসিবত হলো: কবরের চাপ দেওয়া, যা থেকে কেউ রেহাই পাবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয়ই কবরের একটি চাপ রয়েছে, যদি কেউ এ থেকে রক্ষা বা নিরাপদ পেয়ে থাকে তবে সা‘দ ইবন মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রক্ষা পেয়েছেন।”[1]

ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “এ সেই ব্যক্তি যার জন্য ‘আরশ কেঁপে উঠেছিল, আকাশের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়েছে এবং সত্তর হাজার ফিরিশতা তার জানাযায় অংশ গ্রহণ করেছে, তবুও তাকে একটি চাপ দেওয়ার পর তা সরিয়ে নেওয়া হয়।[2]

এ বিষয়ে হাফেজ যাহাবীর রহ. একটি সূক্ষ্ণ তা‘লীক বা সংযুক্তি রয়েছে। তিনি সিয়ারে ‘আলামীন নুবালাতে (১/২৯০-২৯১) যেভাবে নিয়ে এসেছেন এখানে আমি হুবহু তুলে ধরেছি। তিনি বলেন, এ চাপ দেওয়াটা কবরের ‘আযাব বলতে কিছু না বরং এটি একটি সাধারণ যন্ত্রনা যা মুমিন বান্দা পেয়ে থাকে, যেমন পৃথিবীতে কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ছেলে সন্তানের বিয়োগে পেয়ে থাকে, যা তার অসুখের যন্ত্রনা, আত্মা বের হয়ে যাওয়ার যন্ত্রনা, কবরে পরীক্ষা এবং প্রশ্নের যন্ত্রনা, তার জন্য তার পরিবার পরিজনদের ক্রন্দনের প্রতিক্রিয়ার যন্ত্রনা, তার কবর হতে উঠার যন্ত্রনা, হাশরের ময়দানে অবস্থান ও এর ভয়াবহতার যন্ত্রনা এবং জাহান্নামে গমণের যন্ত্রনা ইত্যাদি।

এ সকল ফিতনা সৃষ্টিকারী যন্ত্রনা বা মিথ্যা সংবাদ সবগুলোই মুমিন বান্দাকে পৌঁছাবে আর এগুলো কবরের ‘আযাব নয় এবং জাহান্নামের ‘আযাবও নয়; কিন্তু পরহেজগার বান্দার সাথে আল্লাহ সব কিছুর ব্যাপারে নম্রতা অবলম্বন করবে।

আল্লাহর সাক্ষাৎ ব্যতীত মুমিন ব্যক্তির কোনো প্রশান্তি নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَأَنذِرۡهُمۡ يَوۡمَ ٱلۡحَسۡرَةِ﴾ [مريم: ٣٩]

“এবং আফসোসের দিন তাদেরকে ভীতিপ্রদর্শন করুন।” [সূরা মারিয়ম, আয়াত: ৩৯]

তিনি আরো বলেন,

﴿وَأَنذِرۡهُمۡ يَوۡمَ ٱلۡأٓزِفَةِ إِذِ ٱلۡقُلُوبُ لَدَى ٱلۡحَنَاجِرِ كَٰظِمِينَۚ﴾ [غافر: ١٨]

“আপনি তাদেরকে আসন্ন দিন সম্পর্কে সতর্ক করে দিন, যখন প্রাণ কন্ঠগত হবে।” [সূরা গাফির, আয়াত: ১৮]

সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার নিকট ক্ষমা এবং অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি। এ সকল আন্দোলন সত্যেও আমরা যতটুকু জানি সা‘দ ইবন মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু জান্নাতবাসী এবং শহীদদের সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছেন।

মনে হয় আপনি এ ধারণা করে আছেন যে, যারা সফলকাম হবে তাদের হয়তো ইহকাল এবং পরকালে কোনো বিভীষিকা, আতঙ্ক, দুঃখ-যাতনা এবং ভয় পৌঁছাবে না। আল্লাহর নিকট সুস্থতা কামনা করুন এবং সা‘দ-এর দলের সাথে আমাদিগকে হাশর করার জন্য প্রার্থনা করুন।হে অল্লাহ! আমরা তোমার নিকট ক্ষমা ও সুস্থতা প্রার্থনা করছি এবং তুমি আমাদেরকে মুহাম্মদ ইবন আব্দুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিনি তোমার বান্দা ও রাসূল; তাঁর এবং তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহাবীদের দলে হাশর করুন।

তৃতীয় মাসআলা

রূহসমূহ বাকী অন্যান্য সকল সৃষ্টির মতোই সৃষ্টিজীব। তা আল্লাহর নির্দেশে তৈরিকৃত, লালিত এবং পরিচালিত।[1]

আল্লাহর বাণী:

﴿وَيَسۡ‍َٔلُونَكَ عَنِ ٱلرُّوحِۖ قُلِ ٱلرُّوحُ مِنۡ أَمۡرِ رَبِّي﴾ [الاسراء: ٨٥] 

এর তাফসীরে ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, আল্লাহর নির্দেশে রূহ সৃষ্টির ওপর প্রমাণ করে। অর্থাৎ তা একটি মহান কাজ এবং অনেক বড় বিষয়, তিনি সন্দেহ করে বিস্তারিত আলোচনা করেন নি যেন আত্মার অস্তিত্বের জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও মানুষ নিজের আত্মার হাকীকত সম্পর্কে অপারগতার কথা দৃঢ় ভাবে জানতে পারে।[2] আকিদা তাহাবীয়ার শরাহকারক রূহের মৃত্যু সম্পর্কে বলেন, সঠিক হলো আত্মার মৃত্যু বলা। আর তা হলো শরীর থেকে আত্মা বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক হয়ে যাওয়া। এর মৃত্যুতে উদ্দেশ্য যদি এই হয় তবে তাই হলো মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করা, আর যদি উদ্দেশ্য হয় একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া, তবে এ অনুপাতে তা মারা যায় না; বরং তা শান্তি বা শাস্তিতে বাকী থেকে যায়, যেমন উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।[3]

চতুর্থ মাসআলা

একটি দল পরিষ্কারভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছে, তারা ধারণা করে যে, রূহসমূহ স্থানান্তরিত হয়। অর্থাৎ রূহ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর অন্য শরীরে প্রবেশ করে তার আকৃতি ধারণ করে এবং তারা এ ধারণাও পোষণ করে যে, কোনো রূহ জীব জন্তু, কীট পতঙ্গ ও পশুপাখী ইত্যাদির মধ্যে যার সাথে সামঞ্জস্য ও আকৃতিতে মিলবে তার মধ্যে প্রবেশ করে। এ প্রকার কথা নিতান্তই বাতিল। যার ওপর পূর্বের এবং পরের নবী রাসূলগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন, তা এর পরিপন্থি। তা আল্লাহ এবং পরকালের ওপর কুফুরি করার শামিল।[1]

এ বাতিল মাযহাব বহু পূর্বেই প্রকাশ হয়েছে, তবে আমাদের মাঝে তা নতুন পোশাক পরিধান করে আবার আত্মপ্রকাশ করেছে, নাম দেওয়া হয়েছে (আর রূহিয়া আল হাদীসা) নতুন আত্মা বা (তাহযীবুর রূহ) রূহের উপস্থিতি।

এ বাতিল চিন্তাধারা পশ্চিমা কতগুলো দেশে প্রচলিত আছে এবং প্রায় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে বৃটেন ও আমেরিকায় বিশেষ বিশেষ সংগঠন গঠন করা হয়েছে। এখনো তাদের এ পথভ্রষ্ঠতা এবং ভ্রান্ততা প্রত্যেক চক্ষুষ্মান জ্ঞানবানের জন্য দীপ্তমান।[2]হাফেজ কুরতুবী রহ. এ ব্যাপারে তার কিতাব (আর মুফহীমে) বলেন: তানাসুখীদের কোনো কথার দিকে ভ্রুক্ষেপ করা যাবে না। যারা বলে যে, রূহসমূহ সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য লাভের জন্য অন্যান্য শরীরে স্থানান্তরিত হয় অথচ তা শরী‘আত এবং উলামাগণের ঐক্যমতের পরিপন্থি। এ রকম বিশ্বাসী নিঃসন্দেহে কাফির হয়ে যাবে। কেননা পরকাল এবং এর বিস্তারিত অবস্থার ব্যাপারে আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা জানা যায় সত্যিকারে তা অস্বীকার করা অথচ তারা যা বলে তার কোনো ভিত্তি নেই। সুতরাং তানাসুখের দাবী বাতিল এবং জ্ঞানের দিকে দিয়ে অসম্ভব।[3]  এতে প্রতীয়মান হয় যে, রূহসমূহ এ পার্থিব জীবনে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তার পূনরূত্থান রয়েছে। অতএব, দ্বিতীয়বার শরীরের সাথে পুরোপুরি মহা সাক্ষাত করবে, যেন প্রত্যেক মুকাল্লাফ (প্রাপ্ত বয়স্ক) বান্দা পৃথিবীর কৃতকর্মের ফল লাভ করতে পারে।

পঞ্চম মাসআলা

মৃত্যুর পর রূহসমূহের নির্ধারিত স্থান কোথায় হবে? আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. তার কিতাব আর রূহে এ মাসআলা সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন এবং কতগুলো মতামত উল্লেখ করে একটি সঠিক মত বলে দিয়েছেন। রূহসমূহ বারযাখে এদের নির্দিষ্ট স্থানে পরস্পর পরস্পরে বিরাট ব্যবধান রয়েছে বলে তিনি বলেন।

তন্মধ্যে ইল্লেয়্যিনের সর্বোচ্চে ফিরিশতাগণের সাথে কতগুলো রূহ রয়েছে, এগুলো হচ্ছে নবীদের রূহ। আল্লাহ তাদের সকলের ওপর রহমত বর্ষণ করুন। তাঁদের মধ্যেও তাদের স্থান অনুযায়ী পরস্পরের মধ্যে ব্যবধান রয়েছে। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি‘রাজের রাত্রিতে দেখেছেন।

এমনিভাবে কতগুলো রূহ রয়েছে সবুজ পাখীর পেটের মধ্যে, যে পাখী তার আপন মনে জান্নাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর তা হচ্ছে কতিপয় শহীদদের রূহ, তাও আবার সকল শহীদের রূহ নয়, কেননা তাদের মধ্যে কোনো রূহ কোনো কারণে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারছে না। যেমন, ঋণ, মাতা-পিতার অবাধ্যতা এবং গনীমতের মাল আত্মসাত করা ইত্যাদি। এ সকল কারণে কোনো কোনো শহীদ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে নি বা জান্নাতের দরজায় আটকিয়ে দেওয়া হয়েছে বা তাকে কবরেই আটকানো হয়েছে। শহীদদের মধ্যে কারো স্থান হয়েছে জান্নাতের দরজা আবার কাউকে দু’টি পাখা দেওয়া হয়েছে, যা দ্বারা সে জান্নাতের মধ্যে আপন মনে উড়ে বেড়াচ্ছে। যেমন, তা ছিল জা‘ফর ইবন আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর। জিহাদে তার দু’টি হাত কাটা যাওয়ায় আল্লাহ তাকে এর বদৌলতে দু’টি পাখা দিয়েছেন, যা দ্বারা তিনি ফিরিশতাদের সাথে জান্নাতে স্বাধীন ভাবে উড়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের মধ্যে কতগুলো লোককে পৃথিবীতেই আটকিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের রূহ উপরে (সম্মানিত স্থানে) উঠানো হয় নি। কেননা তা ছিল নীচু পার্থিব রূহ। আর নীচু পার্থিব রূহ আকাশীয় রূহের সাথে একত্রিত হবে না, যেমনভাবে পৃথিবীয় তা একত্রিত হতো না।

যে আত্মা পৃথিবী আল্লাহকে চিনে নি, ভালোবাসে নি, তাকে স্মরণ করে নি, তাঁর নৈকট্য লাভ করে নি; বরং পৃথিবী আত্মা ছিল, সে আত্মা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরও এখানেই থাকবে। যেমনিভাবে উর্ধ্বগামী আত্মা পৃথিবীয় আল্লাহর ভালোবাসায় নিমগ্ন ছিল, তাকে স্মরণ করেছে, তাঁর নৈকট্য লাভ করেছে, সে আত্মা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তার উপযোগী ঊর্ধ্বগামী আত্মার সাথে থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা বারযাখে এবং পূনরুত্থান দিবসে আত্মাসমূহকে জোড়ায় জোড়ায় মিলিয়ে দিবেন এবং মুমিন রূহকে পাক-পবিত্র রূহের সাথে রাখবেন, কেননা প্রত্যেক রূহ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তার আকৃতি বিশিষ্ট রূহ, ভগ্নি এবং তার মতো আমলকারীদের সাথে মিলিত হয়ে তাদের সাথেই থাকবে।কতগুলো রূহ ব্যভিচার নর-নারীদের চুলায় থাকবে, কিছু রূহ রক্তের নদীতে সাঁতার কাটবে আর পাথর গিলবে যা পূর্বে উল্লিখিত সামুরা ইবন জুন্দুব কর্তৃক স্বপ্নের হাদীসে এসেছে। এ থেকে জানা যায় যে, রূহসমূহ  শরীর হতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তার সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য লাভ করার পর একই স্থানে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং কিছু ইল্লিয়্যিনের সর্বোচ্চে আবার কতগুলো নিম্ন ভূমিতে থাকে যা পৃথিবী থেকে উপরে উঠতে পারে না।[1]

ষষ্ট মাসআলা

আল্লাহ তা‘আলা তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন: পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী স্তর, বারযাখের স্তর এবং পরকালীন স্থায়ী স্তর। প্রত্যেক স্তরের জন্য নির্দিষ্ট হুকুম ও বিধান তৈরি করেছেন। মানুষকে শরীর ও রূহের সমন্বয়ে গঠন করে এ তিন স্তরের প্রত্যেক স্তরে এদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র ও বিধান তৈরি করেছেন।

প্রথম স্তর পৃথিবীর জীবন

তা এমন একটি স্তর যাকে আত্মাসমূহ ভালোবেসে এর বুকে লালিত পালিত হয়েছে, এর ভালো-মন্দ এবং সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের কারণগুলো উপার্জন করেছে। পার্থিব জীবনের স্তরের হুকুম শরীরের জন্য প্রযোজ্য, রূহসমূহ এর অনুগত। আর এ জন্যেই আল্লাহ তা‘আলা শর‘ঈ হুকুম জিহ্বা ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বাহ্যিক কর্মের ওপর আরোপিত করেছেন যদিও আত্মাসমূহ এর বিপরীত করে।

ইহকালে শরীরের সাথে রূহের সম্পর্ক একটি বিশেষ ও গভীর সম্পর্ক, আর এ সম্পর্ক শুধু মানুষের ঘুমের সময় এবং মাতৃগর্ভে ভ্রূণ অবস্থায় থাকে। কেননা এক দিক দিয়ে শরীরের সাথে রূহের সম্পর্ক অন্য দিক দিয়ে তা থেকে বিচ্ছিন্ন।

দ্বিতীয় স্তর বারযাখী জীবন

তা পৃথিবীর স্তরের চেয়ে অনেক বড় এবং বিস্তৃত। বরং তা পৃথিবী অপেক্ষা এতই বড় বা বিস্তৃত যেমন মাতৃগর্ভ অপেক্ষা পৃথিবী বড় বা বিস্তৃত।

বারযাখী জীবনের হুকুম বা বিধান রূহের ওপর প্রযোজ্য হয়, শরীর এর অনুগত। পৃথিবীতে রূহ যেমন শরীরের সাথে মিলিত হলে এর দুঃখে দুঃখিত হয় এবং এর বিশ্রামে প্রশান্তি অনুভব করে, শরীরই ‘আযাব বা শান্তির কারণগুলো বয়ে আনে, তেমনিভাবে বারযাখে শরীরগুলো ‘আযাবে এবং শান্তিতে রূহের অনুগত হয় এবং রূহসমূহ তখন শান্তি বা শাস্তি বয়ে আনে। কেননা রূহসমূহ বারযাখে যদিও শরীর হতে বিচ্ছিন্ন এবং পৃথক থাকে; কিন্তু কোনো অস্তিত্ব বাকী না রেখে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না; বরং শরীরের সাথে এর একটি বিশেষ অবস্থায় সম্পর্ক বাকী থাকে। এর প্রমাণ হলো কোনো মুসলিম সালাম দেওয়ার সময় শরীরে রূহ ফিরিয়ে দেওয়া সম্বন্ধে যা এসেছে এবং তার থেকে তার সাথীদের ফিরে যাওয়ার সময় জুতার আওয়াজ শুনার হাদীস, এ ছাড়াও অন্যান্য প্রমাণাদি রয়েছে।

তৃতীয় স্তর পরকালিন স্থায়ী জীবন

আর তা হলো হয় জান্নাত না হয় জাহান্নাম। তারপরে আর কোনো স্তর নেই। আল্লাহ তা‘আলা স্তরে স্তরে ও ধাপে ধাপে রূহগুলো স্থানান্তর করে সেই স্তরে পৌঁছে দেন, যা এর জন্য উপযোগী এবং তা-ই তার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে এবং  আমল করার জন্য তৈরি করা হয়েছে, যা তাকে সে স্তরে পৌঁছে দেবে। এ স্তরে শরীরের সাথে রূহের সম্পর্কই পরিপূর্ণ সম্পর্ক। উল্লিখিত সম্পর্কগুলো এর তুলনা হয় না। সুতরাং তা এমন এক সম্পর্ক যেখানে শরীর মৃত্যু, ঘুম এবং অরাজকতা গ্রহণ করে না, কেননা ঘুম হলো মৃত্যুর ভাই।যে ব্যক্তি তা পরিপূর্ণভাবে জানতে পারে তার নিকট থেকে রূহ এবং এর সম্পর্কতার ব্যাপারে বহু উদ্ভাবিত প্রশ্ন দূর হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা এর প্রস্তুতকারক ও সৃষ্টিকর্তা, মৃত্যু দানকারী এবং জীবন দাতা, এর সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য দানকারী, যিনি এর মাঝে সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য ভেদে বিভিন্ন স্তরে পার্থক্য রেখেছেন, যেমনভাবে পার্থক্য করেছেন এর উচ্চ স্তরে, আমলে, শক্তিতে এবং চরিত্রে। আর যে ব্যক্তি প্রয়োজন অনুপাতে তা জানল সে সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো যোগ্য উপাস্য নেই, তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোনো অংশিদার নেই, তাঁর জন্যই সকল রাজত্ব, সকল প্রশংসা, তাঁর হাতেই সকল মঙ্গল এবং প্রত্যেক কর্ম তার দিকে প্রত্যাবর্তন করে, তার জন্য সকল সামর্থ এবং শক্তি, সম্মান এবং কলা কৌশল এবং সার্বিক দিক দিয়ে তার পূর্ণতা রয়েছে। সে নিজের সত্তাকে চেনার মাধ্যমে সকল নবী রাসূলের সত্যতা জানতে পারবে, তারা যা নিয়ে এসেছেন তা সত্য। সুষ্ঠ জ্ঞান এবং সঠিক দীন এর সাক্ষ্য দেয়, আর যা এর বিপরীত তা বাতিল।[1]

সপ্তম মাসআলা

মৃত ব্যক্তিগণ জীবিত ব্যক্তিদের যিয়ারত এবং তাদেরকে সালাম দেওয়া সম্পর্কে জানতে পারে কি না?

ইবনুল কাইয়্যেম রহ. এ মাসআলা নিয়ে তার কিতাব আর রূহের প্রথম দিকে আলোচনা করে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, মৃত ব্যক্তি নিজে তার যিয়ারতকারীকে চিনে এবং সালামের উত্তর দেয়, তিনি এর প্রমাণও নিয়ে এসেছেন।[1]

প্রমাণপঞ্জি: ইবন আব্দুল বার এবং ইবন আবুদ পৃথিবী ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, “কোনো মুসলিম পৃথিবীয় তার কোনো পরিচিত মৃত ব্যক্তির কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম কালে তার ওপর সালাম দিলে আল্লাহ তার রূহকে ফিরিয়ে দেন যেন সে সালামের উত্তর দিতে পারে।”[2]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতের জন্য বিধান করে তাদেরকে শিখিয়ে গিয়েছেন যে, তারা যখন কবর যিয়ারত করবে তখন বলবে:

«سلام عليكم أهل الديار من المؤمنين والمؤمنات وإنا إن شاء الله بكم لاحقون، يرحم الله المستقدمين منا ومنكم والمستأخرين، نسأل الله لنا ولكم العافية».

“হে কবরবাসী মুমিন ও মুসলিমগণ! তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, আর অতি সত্বর আমরা তোমাদের সাথে মিলিত হব ইনশা আল্লাহ। আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের মধ্যে অগ্রে ও পরে অগমনকারীদেরকে রহমত করুন, আল্লাহর নিকট আমাদের এবং তোমাদের সুস্থতা কামনা করছি।”[3]

এ সালাম, সম্বোধন এবং আহ্বান উপস্থিত ব্যক্তির জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে যে ব্যক্তি শুনতে পায়, যাকে সম্বোধন করা হয় সে তা বুঝে এর উত্তর দেয় যদিও সালামদাতা সালামের উত্তর শুনতে পায় না। অন্যথা এ সম্বোধন ও সালাম হতো কোনো শূন্য ও জড় পদার্থ্যের জন্য, আর তা অসম্ভব ব্যাপার। তাছাড়া যদি তারা তাদের ওপর সালামকারীদের অনুভব না করতে পারে তাহলে যিয়ারতকারী বলা ঠিক হবে না। কেননা যাকে যিয়ারত করা হয় সে যদি তার যিয়ারতকারীকে জানতে না পারে তবে এ কথা বলা ঠিক হবে না যে, সে তাকে যিয়ারত করেছে।আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, সালাফগণ এর ওপর ঐক্যমত এবং তাদের থেকে আছার বা বাণী এসেছে যে, মৃত ব্যক্তি জীবিত ব্যক্তির যিয়ারতকে জানতে পেরে খুশী হয়। মৃতদের না শুনার ব্যাপারে জ্বলন্ত নির্দশন- আল্লামা আল আলুসীর লেখা ও এর ভূমিকায় আল্লামা নাসিরুদ্দীন আল আলবানী।

অষ্টম মাসআলা

মৃতদের রূহসমূহ পরস্পর পরস্পরে সাক্ষাৎ, যিয়ারত এবং একে অপরকে স্মরণ করে কি না? তা একটি গায়েবী বিষয়ক মাসআলা, যা অহীর মাধ্যম ব্যতীত জানা যায় না। কুরআন হাদীসের প্রমাণপঞ্জি তা স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছে। এর বিস্তারিত বর্ণনা হলো (শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া বলেন, পৃথিবীতে মৃত ব্যক্তির পরিবার পরিজন, সঙ্গী-সাথীদের অবস্থা জানার সংবাদ ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হয়েছে, আর তা তার ওপর পেশ করা হয়। মূল উদ্দেশ্য এখানেই শেষ।)[1]

রূহসমূহ দুই প্রকার: সাজাপ্রাপ্ত রূহ এবং শান্তিপ্রাপ্ত রূহ।

সাজাপ্রাপ্ত রূহ হলো তার ওপর অর্পিত শাস্তিতে ব্যস্ত থাকার দরুন অন্যদের সাথে যিয়ারত এবং সাক্ষাৎ করতে পারে না। কিন্তু স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেওয়া শান্তিপ্রাপ্ত রূহসমূহ পৃথিবীয় যেভাবে সাক্ষাৎ, যিয়ারত এবং একে অপরকে স্মরণ করতো এবং পৃথিবীবাসীদের দ্বারা যা হয় সেখানেও তা করে। কাজেই প্রত্যেক রূহ তার বন্ধু ও সহপাঠিদের সাথে থাকবে যারা তার মতো আমল করেছে।

আর আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহ থাকবে সর্বোচ্চ স্থানে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَمَن يُطِعِ ٱللَّهَ وَٱلرَّسُولَ فَأُوْلَٰٓئِكَ مَعَ ٱلَّذِينَ أَنۡعَمَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِم مِّنَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ وَٱلصِّدِّيقِينَ وَٱلشُّهَدَآءِ وَٱلصَّٰلِحِينَۚ وَحَسُنَ أُوْلَٰٓئِكَ رَفِيقٗا ٦٩﴾ [النساء: ٦٩] 

“আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, সে তাদের সঙ্গী হবে যাদেরকে আল্লাহ নি‘আমত দান করেছেন, তারা হলেন নবী, সিদ্দিক, শহীদ এবং সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ আর তাদের সান্নিধ্যই উত্তম।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬৯]

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, এ সহচার্য্য পৃথিবী, বারযাখ এবং পরকালে হওয়া সাব্যস্ত রয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তি এ তিন স্তরে তার পছন্দনীয় ব্যক্তির সাথে থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿يَٰٓأَيَّتُهَا ٱلنَّفۡسُ ٱلۡمُطۡمَئِنَّةُ ٢٧ ٱرۡجِعِيٓ إِلَىٰ رَبِّكِ رَاضِيَةٗ مَّرۡضِيَّةٗ ٢٨ فَٱدۡخُلِي فِي عِبَٰدِي ٢٩ وَٱدۡخُلِي جَنَّتِي ٣٠﴾ [الفجر: ٢٧،  ٣٠] 

“হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে তোমার রবের নিকট ফিরে যাও। অতঃপর আবার আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।” [সূরা আল-ফাজর, আয়াত: ২৭-৩০]

অর্থাৎ তাদের মধ্যে প্রবেশ করে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। আর তা মৃত্যুর সময় রূহকে লক্ষ্য করে বলা হয়।

আল্লাহ তা‘আলা শহীদদের সম্পর্কে এবং তাদের শহীদ হওয়ার পর যার সম্মুখীন হয় তা সম্বন্ধে সংবাদ দিয়ে বলেন,

﴿وَلَا تَحۡسَبَنَّ ٱلَّذِينَ قُتِلُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ أَمۡوَٰتَۢاۚ بَلۡ أَحۡيَآءٌ عِندَ رَبِّهِمۡ يُرۡزَقُونَ ١٦٩ فَرِحِينَ بِمَآ ءَاتَىٰهُمُ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦ وَيَسۡتَبۡشِرُونَ بِٱلَّذِينَ لَمۡ يَلۡحَقُواْ بِهِم مِّنۡ خَلۡفِهِمۡ أَلَّا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ١٧٠﴾ [ال عمران: ١٦٩،  ١٧٠] 

“আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে তোমরা মৃত মনে করো না; বরং তারা তাদের রবের নিকট জীবিত এবং জীবিকাপ্রাপ্ত। আল্লাহ নিজের অনুগ্রহ থেকে তাদেরকে যা দান করেছেন তাতে তারা আনন্দ উপভোগ করছে, আর তাদের পরে আসা এখনো যারা তাদের সাথে মিলিত হয় নি, তাদেরকে নিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে, কারণ তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৯-১৭০]

এ আয়াতদ্বয় তাদের পরস্পর পরস্পরে সাক্ষাতের প্রমাণ করে তিন দিক দিয়ে।

প্রথম দিক: তারা তাদের রবের নিকট জীবিত এবং জীবিকা প্রাপ্ত, যেহেতু তারা জীবিত সেহেতু তারা পরস্পরে সাক্ষাত করে থাকে।

দ্বিতীয় দিক: তাদের নিকট আগমণকারী এবং তাদের সাথে সাক্ষাতকারী ব্যক্তিদের নিয়ে তারা আনন্দ প্রকাশ করে থাকে।

তৃতীয় দিক: (ইয়াস্তাবশিরুন) শব্দটি আভিধানিক অর্থে একে অপরকে সুসংবাদ দানের উপকারিতা দেয়, যেমন (ইয়াতাবাশারুন) শব্দটি।

মৃত্যুর পর মুমিনদের রূহসমূহ পরস্পরে সাক্ষাতের আরো কিছু প্রমাণাদি হলো যা ইমাম নাসাঈ, ইবন হিব্বান ও হাকিমের নিকট সহীহ সনদে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে এসেছে, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যখন মুমিন ব্যক্তির মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন তার নিকট রহমতের ফিরিশতা শুভ্র রেশমী কাপড় নিয়ে এসে বলে: হে রূহ! অতি আনন্দের সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও বিশ্রামের দিকে বের হয়ে আস, তোমার প্রতি আল্লাহ গোস্বা নন। তখন সে মিশকে আম্বরের ন্যায় সুগন্ধ নিয়ে বেরিয়ে আসে, তখন তাদের পরস্পরের সাথে সাক্ষাত লাভ হয়, এমনকি আকাশের দরজায় নিয়ে আসার পূর্ব পর্যন্ত। অতঃপর তারা বলে তোমাদের পৃথিবী থেকে আসা সুগন্ধি কতইনা ভালো! তারপর তাকে মুমিনদের রূহের নিকট নিয়ে আসলে তারা অধিক আনন্দিত হয়, যেমন তোমাদের মধ্যে কোনো অনুপস্থিত ব্যক্তির আগমনে আনন্দিত হও। অতঃপর তারা তাকে জিজ্ঞাসা করে: অমুক কি করে? অমুক কি করে? তারা বলে: আরে ছাড় তার কথা! তাকে বিশ্রাম নিতে দাও, কারণ সে পৃথিবীয় অশান্তিতে ছিল। সে যখন বলবে: অমুক কি তোমাদের নিকট আসে নি? তারা বলবে: তাকে তার মায়ের নিকট হাবিয়াতে (জাহান্নামে) নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

আর কাফেরের নিকট যখন মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন তার নিকট শাস্তির ফিরিশতা পশমের এক টুকরা কাপড় নিয়ে এসে বলে: হে  রূহ! অসন্তুষ্টি নিয়ে আল্লাহর শাস্তির দিকে বের হয়ে আস, তখন মৃত দুর্গন্ধযুক্ত জানোয়ারের ন্যায় দুর্গন্ধ নিয়ে বেরিয়ে আসলে তারা তাকে নিয়ে পৃথিবীর দরজা পর্যন্ত আসবে, অতঃপর তারা বলতে থাকবে: এ বাতাস কতইনা দুর্গন্ধযুক্ত, যতক্ষণ না তারা একে নিয়ে কাফিরদের রূহের নিকট আসবে।”

বারযাখী জীবন সংক্রান্ত এবং এর সাথে সম্পৃক্ত আনুসাঙ্গিক ব্যাপারে উল্লিখিত আলোচনার মাধ্যমে আমাদের নিকট একটি জিনিস পরিষ্কার হয় যে, আমরা যে দিকে ধাবিত হচ্ছি তা কত কঠিন এবং কত বড়। এর পরেও আমরা আনুগত্যে অনেক ধীরস্থির, নিষিদ্ধ কাজ হতে বিরত থাকা থেকে শিথিলতা করছি অথচ দীর্ঘ আশা আকাঙ্খা, নির্দিষ্ট সময়ের দীর্ঘ জীবনই আমাদেরকে হক থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। নিশ্চয়ই তা একটি ধ্বংস, যার পরেও রয়েছে ধ্বংস এবং একটি ক্ষতি যার পরে কোনো লাভ এবং সংশোধন নেই। কিন্তু আল্লাহ যদি আমাদেরকে তাঁর রহমত এবং অনুগ্রহ দ্বারা বেষ্টন করে রাখেন।হে আল্লাহ! তোমার শক্তি ব্যতীত আমাদের কোনো শক্তি নেই, হে আল্লাহ আমরা তোমার সমত্তষ্টি এবং জান্নাত চাই। হে আল্লাহ! তোমার অসন্তুষ্টি এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাই। হে আল্লাহ আমাদেরকে, আমাদের পিতা-মাতা এবং মুসলিম ভ্রতৃবৃন্দকে রহমত করুন।

একটি সতর্কতা

এ মাসআলার ভিত্তি হলো মৃতদের শুনার সঠিকতার ওপর, না শুনার ওপর নয়। অর্থাৎ মৃতরা কি তাদের ওপর সালামকারীর সালাম এবং কথা শুনতে পায়? উলামায়ে কেরামের মধ্যে এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে।[1]

প্রমাণের মাধ্যমে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী মত হয়তো সেটাই যিনি বলেছেন যে, মৃতদের শ্রবণশক্তি রয়েছে। আর তা সেই অবস্থাসমূহে যার ওপর কুরআন ও সহীহ হাদীস প্রমাণ করে। যেমন, তার থেকে ফিরে যাওয়া আত্মীয় স্বজনদের জুতার আওয়াজ শুনা ও কোনো মুসলিমের সালাম দেওয়া ইত্যাদি।

অনেক মুহাকিক উলামা ঐক্যমত পোষণ করেছেন। যেমন, শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া, আল্লামা ইবনু কাইয়্যেম, হাফেয ইবন কসীর ও হাফেয কুরতুবীসহ অন্যান্য উলামায়ে কেরাম।[2] কিন্তু শোনার পদ্ধতি কেবল আল্লাহ তা‘আলাই ভালো জানেন।

মোটকথা, যদি এমনও বলা হয় যে, মৃত ব্যক্তিগণ সাধারণত শুনে থাকে, তবুও তাদের কবরে তাদের রূহ এবং শরীরের আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ইহকালীন জীবন থেকে ভিন্নতর। যেমন, তাদের মৃত্যুতে তাদের নড়াচড়া বা পিছনে ফেলে আসা কাজ কর্মের ওপর কোনো প্রতিক্রিয়া করা, এগুলো বন্ধ হয়ে যায়।

এ পরিপেক্ষিতে বলা যায় যে, একথা বিশ্বাস করা প্রত্যেক নর-নারীর ওপর একান্ত কর্তব্য যে, মৃতদের নিকট দো‘আ চাওয়া, তাদের নিকট কোনো কিছু চাওয়া, তাদেরকে মাধ্যম মানা ও তাদের জন্য কোনো মান্নত করা শরী‘আত পরিপন্থী এবং জ্ঞানের অজ্ঞতা প্রকাশ করার নামান্তর।

শরী‘আত পরিপন্থী হলো এতে আল্লাহর সাথে অংশিদার করা হয়, যা ইসলাম থেকে বহিষ্কার করে দেয় অথবা এর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَأَنَّ ٱلۡمَسَٰجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدۡعُواْ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدٗا ١٨ ﴾ [الجن: ١٨]

“এবং সকল মসজিদ আল্লাহর জন্যই। বিধায় তোমরা তাঁর সাথে অন্য কাউকে ডেকো না”। [সূরা আল-জিন্ন, আয়াত: ১৮]

তিনি আরো বলেন,

﴿وَمَن يَدۡعُ مَعَ ٱللَّهِ إِلَٰهًا ءَاخَرَ لَا بُرۡهَٰنَ لَهُۥ بِهِۦ فَإِنَّمَا حِسَابُهُۥ عِندَ رَبِّهِۦٓۚ إِنَّهُۥ لَا يُفۡلِحُ ٱلۡكَٰفِرُونَ ١١٧﴾ [المؤمنون: ١١٧] 

“যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যকে ডাকে, যার কোনো সনদ তার নিকট নেই, তার হিসাব-নিকাশ তার পালনকর্তার নিকট রয়েছে, নিশ্চয় কাফিরগণ সফলকাম হবে না।” [সূরা আল-মুমিনূন, আয়াত: ১১৭]

তিনি আরো বলেন,

﴿ذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمۡ لَهُ ٱلۡمُلۡكُۚ وَٱلَّذِينَ تَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ مَا يَمۡلِكُونَ مِن قِطۡمِيرٍ ١٣ إِن تَدۡعُوهُمۡ لَا يَسۡمَعُواْ دُعَآءَكُمۡ وَلَوۡ سَمِعُواْ مَا ٱسۡتَجَابُواْ لَكُمۡۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يَكۡفُرُونَ بِشِرۡكِكُمۡۚ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثۡلُ خَبِيرٖ ١٤﴾ [فاطر: ١٣،  ١٤] 

“তিনিই আল্লাহ, তোমাদের রব, তাঁর জন্য সাম্রাজ্য, তাঁর পরিবর্তে তোমরা যাদেরকে ডাক তারা সামান্য একটি খেজুর আঁটির অধিকারীও নয়। যদি তোমরা তাদেরকে ডাক তারা তোমাদের ডাক শুনবে না, শুনলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দিবে না আর কিয়ামতের দিন তোমাদের শির্ককে অস্বীকার করবে। বস্তুতঃ আল্লাহর ন্যায় তোমাকে কেউ অবহিত করবে না।” [সূরা ফাতির, আয়াত: ১৩-১৪]

আর অজ্ঞতা হলো যে ব্যক্তি কবরবাসী এবং তাদের মাজারে গিয়ে প্রার্থনা করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের নিকট সেই জিনিস চেয়ে বসে, যা তার সাধ্যের বাহিরে অথচ তারা (প্রশ্নকারী) জীবিত অথবা তাদের নিকট এমন জিনিস চায়. যা সে নিজেই করার ক্ষমতা রাখে। কেননা সে জীবিত উপস্থিত এবং তার পছন্দ রয়েছে। কিন্তু (তারা মৃত) পৃথিবী এবং তাদের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, পৃথিবীর কোনো ব্যাপারে এদিক সেদিক করার কোনো সুযোগ তাদের নেই।মৃতদের শুনার মাসআলার পর তা একটি সতন্ত্র সতর্কতা বর্ণনা করার একান্ত আবশ্যকীয়তার চাহিদা রাখে, কেননা বহু লোক এতে ভুল করে থাকে। উপরন্তু শির্কের মধ্যে পতিত হওয়ার জন্য তা একটি তৈরিকৃত দরজা হওয়ার কারণ এ মাসআলা। বিস্তারিত বর্ণনার নির্দিষ্ট স্থান রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের তাওফীক দান করুন।

Jahirul.Islam

Share
Published by
Jahirul.Islam

Recent Posts

How Much Does It Cost to Build a Barndominium in 2025

If you're thinking about building a barndominium in 2025, you're not alone. These barn-style homes…

5 days ago

How Long Does It Take to Charge a Car Battery

A dead or drained car battery can be a frustrating issue, especially when you're in…

6 days ago

How Can I Plan a Trip to PR by Myself

Dreaming of a tropical escape but want to explore on your own terms? If you’ve…

6 days ago

How to Teach My Four Year Old to Share

Teaching your child to share is one of the most valuable lessons they’ll learn in…

6 days ago

How to Dispose of Old Gasoline Safely and Legally

Old gasoline sitting in your garage or shed can pose serious risks to your health,…

6 days ago

How to Date an Entity Hentai

If you’re a fan of anime and are curious about the stranger, more supernatural side…

6 days ago