মিরাজ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ(সা) এর জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর, অলৌকিক ও শিক্ষামূলক ঘটনা।
রাত্রে সংঘটিত হয়েছে বলে অনেকে একে স্বপ্ন ভেবে বিভ্রান্ত হয়েছে। আসলে এটি একটি বাস্তব ঘটনা। রাসূলুল্লাহ (সা) সম্পূর্ণ জাগ্রত ও সচেতন অবস্থায় ফেরেশতাদের সাহচর্যে প্রথমে বায়তুল মোকাদ্দাস এবং পরে সেখান থেকে সাত আসমান ও তারও উর্ধ্ব জগত পরিভ্রমণ করেন।
এই ঘটনা সম্পর্কে নিম্নে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম হতে সমন্বিত বিবরণ উদ্ধৃত করা হচ্ছে।
রাসূলুল্লাহ(সা) একদিন সকালে সাহাবায়ে কেরামের মজলিশে বললেন, “গত রাত্রে আমার প্রতিপালক আমাকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেছেন।গত রাত্রে আমি যখন মসজিদুল হারামে ঘুমিয়ে ছিলাম, তখন তিনজন ফেরেশতা আমার কাছে আসলেন।
তাঁরা আমাকে জাগিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে যমযম কুয়ার কাছে নিয়ে রাখলেন। অতঃপর জিবরীল আমার গলা থেকে বুক পর্যন্ত চিরে ফেললেন এবং আমার বুক ও পেটের ভেতর থেকে সমুদয় বস্তু বের করলেন।
তারপর নিজ হাতে জমযমের পানি দ্বারা ধুয়ে আমার পেট পবিত্র করলেন। অতঃপর একটি সোনার পাত্র আনা হলো। ঐ পাত্র থেকে ঈমান ও হিকমত নিয়ে বুক ও গলার ধমনীগুলো পূর্ণ করলেন এবং জোড়া লাগিয়ে দিলেন। অতঃপর আমাকে মসজিদুল হারামের দরজায় আনা হলো। সেখানে জিবরীল আমাকে বহন করার জন্য খচ্চর সদৃশ বোরাক নামক একটি জন্তু পেশ করলেন। জন্তুটি ছিল শ্বেত বর্ণের। আমি যখন তাতে আরোহণ করলাম, তখন তা এত দ্রুত গতিতে চলতে লাগলো যে, তার পেছনের পা দুটি যে স্থানে স্পর্শ করে, সেখান থেকে সামনের পা যেখানে পড়ে তার দূরত্ব দৃষ্টিসীমার দূরত্বের সমান। এভাবে তা আমাকে বিদ্যুৎবেগে নিয়ে বায়তুল মাকদাসে গিয়ে উপনীত হলো। এখানে জিবরীলের ইংগীতে বোরাকটিকে মাসজিদুল আকসার দরজার কাছে একটি বিশেষ জায়গায় বেঁধে রাখা হলো। বনী ইসরাঈলের নবীগণ এই মসজিদে নামায পড়তে এসে তাদের বাহনকে এ জায়গায় বেঁধে রাখতেন।
অতঃপর আমি মসজিদুর আকসার ভিতর প্রবেশ করে দু’রাকাত নফল নামায পড়লাম। কোনো কোনো বর্ণনা অনুসারে, পূর্ববর্তী সকল নবীগণের ইমাম হয়ে জামায়াতে নামায পড়লাম। তারপর সেখান হতে উর্ধ্বজগতে আরোহনের প্রস্তুতি শুরু হলো। প্রথমে জিবরীল আমার সামনে দু’টি পেয়ালা পেশ করলেন। এর একটিতে দুধ ও অপরটিতে মদ ছিল। আমি দুধের পেয়ালা গ্রহণ করলাম এবং মদের পেয়ালা ফেরত দিলাম। তা দেখে জিবরীল বললেন, আপনি দুধের পেয়ালা গ্রহণ করে স্বাভাবিক দ্বীনকে গ্রহণ করেছেন।
অতঃপর উর্ধ্বজগতের ভ্রমণ শুরু হলো। আমাকে ও জিবরীলকে নিয়ে বোরাক আকাশের দিকে উড়ে চলল। আমরা প্রথম আসমানে পোঁছলে জিবরীল দ্বাররক্ষী ফেরেশতাদেরকে দরজা খুলে দিতে বললেন। রক্ষী ফেরেশতারা জিজ্ঞেস করলেন, কে? জিবরীল উত্তর দিলেন, আমি জিবরীল। ফেরেশতারা জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সংগে কে? জিবরীল উত্তর দিলেন, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ফেরেশতারা পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি আল্লাহর নিমন্ত্রণ পেয়ে এসেছেন? জিবরীল বললেন, অবশ্যই।
ফেরেশতারা দরজা খুলতে খুলতে বললেন, এমন ব্যক্তির আগমন মোবারক হোক। আমরা যখন প্রথম আকাশে প্রবেশ করলাম, প্রথমেই হযরত আদম(আ)এর সাথে দেখা হল। জিবরীল আমাকে বললেন, ইনি আপনার পিতা আদম আলাইহিস সালাম। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনি আমার সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, স্বাগতম, হে সম্মানিত পুত্র ও সম্মানিত নবী। অতঃপর দ্বিতীয় আসমানে পৌঁছলাম। এখানে প্রথম আসমানের মত প্রশ্নোত্তরের পালা অতিক্রম করে দরজা দিয়ে প্রবেশ করলাম। সেখানে হযরত ইয়াহিয়া ও ঈশা(আ) এর সাথে সাক্ষাত হলো। জিবরীল আমাকে তাঁদের উভয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং বললেন, আপনিই আগে সালাম করুন।
আমি সালাম করলে তাঁরা উত্তর দিয়ে বললেন, “স্বাগতম, হে সম্মানিত ভাই ও সম্মানিত নবী।” অতঃপর তৃতীয় আসমানে পৌঁছলে পূর্বের মত ঘটনাই ঘটলো এবং সেখানে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের সাথে সাক্ষাত হলো। জিবরীল আমাকে বললেন, আপনিই আগে সালাম করুন। আমি সালাম করলে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, “স্বাগতম, হে সম্মানিত ভাই ও সম্মানিত নবী।” অতঃপর চতূর্থ আসমানে একইরকম প্রশ্নোত্তর পর্ব অতিক্রম করে হযরত ইদরীস আলাইহিস সালামের সাক্ষাত হলো। অতঃপর পঞ্চম আসমানে হযরত হারূন (আ) ও ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা (আ) এর সাথে একইভাবে সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হলো।
কিন্তু হযরত মূসার(আ) কাছ হতে বিদায় নেয়ার সময় তাঁর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আপনার এই অসাধারণ মর্যাদার জন্য আমার ঈর্ষা হচ্ছে যে, আপনার উম্মত আমার উম্মতের তুলনায় বহু গুণ বেশী বেহেশতবাসী হবে। অতঃপর পূর্বোক্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব অতিক্রম করে আমরা যখন সপ্তম আসমানে পৌঁছলাম, তখন সেখানে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সাথে সাক্ষাত হলো। তিনি সেখানে বায়তুল মা’মুরের দেয়ালের সাথে পিঠ লাগিয়ে বসেছিলেন। এই বায়তুল মা’মুরে প্রতিদিন সত্তর হাজার নতুন নতুন ফেরেশতা প্রবেশ করেন।
তিনি আমার সালামের জবাব দিয়ে বললেন,“স্বাগতম, হে সম্মানিত ভাই ও সম্মানিত নবী।” অতঃপর সেখান থেকে আমাকে সিদরাতুল মুনতাহায় (শাব্দিক অর্থে সীমান্তের বরই গাছ, তবে এটি আসলে কি গাছ তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না) নিয়ে যাওয়া হলো।
অতঃপর আল্লাহ আমাকে সম্বোধন করে হুকুম দিলেন যে, আপনার ও আপনার উম্মতের উপর ৫০ ওয়াক্ত নামায ফরয হলো। অতঃপর আমি নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম। পথিমধ্যে হযরত মূসা(আ) এর সাথে সাক্ষাত হলো। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এই মিরাজের সফরে আপনি কি উপঢৌকন পেলেন? আমি বললাম, ৫০ ওয়াক্ত নামায। তিনি বললেন, আপনার উম্মত এই ভারী বোঝা বহন করতে পারবে না। সুতরাং আপনি আবার ফিরে যান এবং আরো কমিয়ে দেয়ার আবেদন জানান। কেননা আমি আপনার পূর্বে নিজের উম্মাতকে পরীক্ষা করেছি। এ কথা শুনে আমি আল্লাহর দরবারে ফিরে গেলাম এবং মিনতি জানানোর পর ৫ ওয়াক্ত কমিয়ে দেয়া হলো।
অতঃপর মূসার কাছে আসলে তিনি পুনরায় বললেন, এখনো অনেক বেশী রয়েছে, আবার যান এবং আরো কমিয়ে আনুন। আমি আবার গেলাম। এবারও আরো ৫ ওয়াক্ত কমানো হলো। অতঃপর মূসার পীড়াপীড়িতে আবার যাই এবং আবার ৫ ওয়াক্ত কমিয়ে আনি। এভাবে কয়েকবার গিয়ে কমাতে কমাতে যখন মাত্র ৫ ওয়াক্ত বাকী রইল, তখনও মূসা আমাকে বললেন, আমি বনী ইসরাঈলের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আপনার উম্মাত ৫ ওয়াক্তও সহ্য করতে পারবে না। সুতরাং আবার যান এবং কমিয়ে আনুন।
কেননা প্রতিবার ৫ ওয়াক্ত কমানো হয়েছে। এবার গেলেও হয়তো ৫ ওয়াক্ত কমানো হবে।
তখন আমার হাতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। আমি এখন পুনরায় কমানোর আবেদন জানাতে লজ্জাবোধ করছি।”
বুখারী শরীফের রেওয়ায়াতে আরো বলা হয়েছে যে, শেষবারেও রাসূলুল্লাহ(সা) আল্লাহর কাছে যান এবং বলেন, হে প্রতিপালক! আমার উম্মাতের শরীর, মন, শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি খুবই দুর্বল। অতএব আমার প্রতি এ নির্দেশকে আরো হালকা করে দিন। তখন আল্লাহ তায়ালা বললেনঃ হে মুহাম্মদ! রাসূল (সা) জবাব দিলেনঃ হে প্রভু, আমি হাযির। আল্লাহ বললেনঃ আমার নির্দেশের কোনো রদবদল হয় না।
আমি তোমাদের প্রতি যা ফরয করেছিলাম, তা উম্মুল কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। প্রত্যেক সত কাজের নেকী দশগুণ। উম্মুল কিতাব বা লওহে মাহফুযে পঞ্চাশ ওয়াক্তই লিখা থাকলো। শুধু তোমার ও তোমার উম্মাতের জন্য তা ৫ ওয়াক্ত করা হলো।
এরপর তিনি নেমে এলেন এবং নিজেকে জাগ্রত অবস্থায় মসজিদুল হারামে উপনীত দেখতে পেলেন।
শিক্ষাঃ মিরাজের ঘটনার শিক্ষা অনেক।
এখানে তার মাত্র কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শিক্ষা তুলে ধরছি।
(১) নামায যে ইসলামী ইবাদতগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা এই ঘটনা হতে দিবালোকের মত স্পষ্ট। আল্লাহ অন্যান্য সকল ইবাদত ফরয করার জন্য ওহী নাযিল করাই যথেষ্ট মনে করেছেন। কিন্তু নামায ফরয করার জন্য ১১৩ বার নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও তাকে যথেষ্ট মনে করেন নি।
বিশেষভাবে দাওয়াত দিয়ে রাসূল(সা) কে নিজের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে নিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামায এমন ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় ফরয করলেন যে, প্রতি ওয়াক্তের নামায দশটি ওয়াক্তের সমান বলে ধারণা দেয়া হলো।
যাতে এর একটি ওয়াক্তও কেউ তরক করার সাহস না পায়।
(২) রাসূলুল্লাহ(সা) সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পূর্ববর্তী সকল নবীকে প্রথমে সালাম দিয়েছেন।
এ দ্বারা ইসলামের এ শিক্ষাই প্রতিফলিত হয়েছে যে, কোন জায়গায় আগে থেকে উপস্থিত ব্যক্তি এবং পরে
আগত ব্যক্তির মধ্যে শেষোক্ত ব্যক্তির কর্তব্য প্রথমোক্ত ব্যক্তিকে সালাম করা, চাই মর্যাদার দিক দিয়ে যিনিই শ্রেষ্ঠ হোন না কেন।