হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে সবার সাথে ভ্রাতৃত্বসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখার ফযীলত অসামান্য। এ নিন্দনীয় স্বভাব পরিহার করে উদার মানসিকতার অধিকারী হ’তে পারলে পরকালে জান্নাত লাভ করা যাবে ইনশাআল্লাহ। এ সম্পর্কেই নিম্নোক্ত হাদীছ।-
আনাস বিন মালেক (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমরা একদিন রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে মসজিদে বসা ছিলাম। তিনি বললেন, এখনই এই গিরিপথ হ’তে তোমাদের নিকট একজন জান্নাতী ব্যক্তি আগমন করবে।
অতঃপর একজন আনছার ছাহাবী আগমন করলেন, যার দাড়ি দিয়ে ওযূর পানি ঝরছিল এবং তিনি তার বাম হাতে জুতা জোড়া ঝুলিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি সালাম দিলেন। যখন পরের দিন আসল তখন রাসূল (ছাঃ) পূর্বের দিনের ন্যায় বক্তব্য পেশ করলেন।
ইতিমধ্যে লোকটি প্রথম বারের মতো আগমন করলেন। তৃতীয় দিনের আগমন ঘটলে রাসূল (ছাঃ) পূর্বের মত মন্তব্য পেশ করলেন। তখন ঐ লোকটি আগের অবস্থায় আগমন করলেন। অতঃপর নবী করীম (ছাঃ) যখন মসজিদ থেকে প্রস্থান করলেন, তখন আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আছ (রাঃ) ঐ ব্যক্তির পিছু নিলেন।
তিনি বলেন, আমি আমার পিতার সাথে দ্বিমত পোষণ করে কসম করে বলেছি যে, আমি তিন দিন তার নিকটে প্রবেশ করব না। আপনি যদি আমাকে আপনার নিকটে আশ্রয় দেন এবং এভাবে তিন দিন চলে যায় তাহ’লে আমি সেটিই করব। তিনি বললেন, ঠিক আছে।
আনাস (রাঃ) বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর বর্ণনা করেন, তিনি তার সাথে তিন রাত্রি অতিবাহিত করলেন। কিন্তু তিনি তাকে রাতের কোন সময় জাগ্রত হয়ে ইবাদত করতে দেখলেন না। তবে তার যখনই ঘুম ভাঙ্গছিল বা বিছানায় পার্শ্ব পরিবর্তন করছিলেন, তখনই আল্লাহর যিকির করছিলেন এবং তাকবীর পাঠ করছিলেন।
[রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি রাতে ঘুম ভাঙ্গার সময় বলবে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহূ লা শারীকা লাহূ লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়াহুয়া ‘আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর, আল-হামদু লিল্লা-হি ওয়া সুবহা-নাল্লা-হি, ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়া আল্লাহু আকবার, ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লা-হ। ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন মা‘বূদ নেই।
তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁরই রাজত্ব, তাঁরই প্রশংসা এবং তিনি হ’লেন সর্বশক্তিমান। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, আল্লাহ পবিত্র, আল্লাহ ব্যতীত কোন মা‘বূদ নেই, আল্লাহ মহান, নেই কোন ক্ষমতা, নেই কোন শক্তি আল্লাহ ছাড়া’।
অতঃপর বলে, রাবিবগ ফিরলী। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও বা দো‘আ করে তাহ’লে তার দো‘আ কবুল করা হবে। যদি সে ওযূ করে ছালাত আদায় করে তবে তার ছালাত কবূল করা হবে’ (বুখারী হা/১১৫৪; মিশকাত হা/১২১৩)।
তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ প্রতি রাতের তৃতীয় প্রহরে নিম্ন আকাশে অবতরণ করেন এবং ফজর পর্যন্ত বান্দাদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, কে আছ আমাকে আহবানকারী, আমি তার আহবানে সাড়া দেব। কে আছ আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে দান করব।
কে আছ আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করব’। এভাবে বলতে থাকেন যতক্ষণ না ফজরের আলো স্পষ্ট হয়’ (বুখারী হা/১১১৫; মুসলিম হা/৭৫৮; মিশকাত হা/১২২৩)]।
অবশেষে ফজরের আযান হ’লে ছালাতের জন্য জাগ্রত হ’লেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, আমি তাকে কেবল ভালো কিছু বলতে শুনতাম। যখন তিন রাত অতিবাহিত হয়ে গেল এবং আমি তার আমলসমূহকে প্রায় তুচ্ছ জ্ঞান করছিলাম, তখন তাকে বললাম, হে আল্লাহর বান্দা!
আমি ও আমার পিতার মাঝে কোন রাগারাগি বা বিচ্ছেদ ছিল না। কিন্তু আমি রাসূল (ছাঃ)-কে তিনবার বলতে শুনেছি যে, এখন তোমাদের নিকট একজন জান্নাতী ব্যক্তি আগমন করবে। এরপর তিনবারই আপনি আগমন করলেন।
তাই আমি ইচ্ছা করলাম যে, আপনার নিকটে অবস্থান করে আপনার আমল পর্যবেক্ষণ করব এবং আপনাকে অনুকরণ করব। কিন্তু আমি আপনাকে তেমন বেশী আমল করতে দেখলাম না। সুতরাং কোন আমল আপনাকে রাসূল (ছাঃ)-এর বাণীর মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে। তিনি বললেন, তুমি যা দেখেছ তাই আমল করি।
তিনি বলেন, যখন আমি তার নিকট হ’তে চলে যাচ্ছিলাম তখন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, তুমি আমাকে যা করতে দেখেছ আমি এর বেশী কিছু করি না। তবে আমার হৃদয়ে মুসলমানদের কারো প্রতি বিদ্বেষ অনুভব করি না এবং আল্লাহ তা‘আলা বিশেষভাবে কাউকে কিছু দান করলে আমি কারো প্রতি হিংসা পোষণ করি না।
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলন, এই গুণই আপনাকে এই মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে। আর এটিই আমরা করতে সক্ষম হই না (আহমাদ হা/১২৭২০; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/২০৫৫৯)। ইরাক্বী, হায়ছামী ও শু‘আইব আরনাঊত বলেন, এর সনদ ছহীহ’ (আহমাদ হা/১২৭২০; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৩০৪৮; তাখরীজুল ইহইয়া হা/৩১৪৯)।
শায়খ আলবানী হাদীছটিকে প্রথমে ছহীহ (যঈফাহ ১/২৫, ভুমিকা দ্রঃ) বললেও পরে এর সনদ দোষমুক্ত নয় বলে মত পোষণ করেছেন’ (যঈফ তারগীব হা/১৭২৮, তারাজু‘আতুল আলবানী হা/৪৮)।
শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, এ থেকে বুঝা যায় তিনি সকল প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত ও নিরাপদ ছিলেন। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা আনছারী ছাহাবীদের প্রশংসা করে বলেছেন, ‘আর মুহাজিরদেরকে যা প্রদান করা হয়েছে, তার জন্য এরা তাদের অন্তরে কোন ঈর্ষা অনুভব করে না এবং নিজেদের অভাব থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ওপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়।
যাদের মনের কার্পণ্য থেকে রক্ষা করা হয়েছে, তারাই সফলকাম’ (হাশর ৫৯/১০)। অর্থাৎ তাদের মুহাজির ভাইদেরকে যা দান করা হয়েছে, তা থেকে (মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১০/১১৮-১১৯)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা পরস্পরের ছিদ্রান্বেষণ করো না, হিংসা করো না, বিদ্বেষ করো না, চক্রান্ত করো না।
তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসাবে সকলে ভাই ভাই হয়ে যাও’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫০২৮)। রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাসমূহ খোলা হয় এবং এমন সব বান্দাকে মাফ করে দেওয়া হয়, যারা আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করে না।
তবে ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করা হয় না, যার মধ্যে ও তার কোন ভাইয়ের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ বিদ্যমান। তখন ফেরেশতাগণকে বলা হয়, এদেরকে পরস্পরে মীমাংসা করার জন্য সুযোগ দাও’ (মুসলিম হা/২৫৬৫; মিশকাত হা/৫০২৯)। অতএব আসুন! হিংসা-বিদ্বেষ ত্যাগ করে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করি। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন-আমীন!