এ মাসআলা সাব্যস্ত করার ব্যাপারে কতিপয় উলামার কিছু মতামত পেশ করা হলো। আহলে সুন্নাতগণ ঐক্যমত পোষণ করেন যে, যখন কোনো ব্যক্তি মারা যায়, তখন সে শাস্তিতে না হয় শান্তিতে থাকে। আর তা আত্মা এবং শরীর উভয়ের ওপর সংঘটিত হয়, তেমনিভাবে রূহ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তা ভোগ করে থাকে। কখনো শরীরের সাথে মিলিত হয় তখন উভয়েরই শান্তি এবং শাস্তি হয়। অতঃপর যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে তখন রূহসমূহ শরীরে ফিরিয়ে দিলে তারা তাদের কবর থেকে বিশ্ব প্রতিপালকের জন্য উঠে দাঁড়াবে।
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া রহ. বলেন, হাদীস বিশারদগণ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিকট এ সকল বর্ণনা ঐক্যমত।[1]
ইবনুল কাইয়্যেম ইমাম আহমাদ রহ. থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, কবরের ‘আযাব সত্য, কেবল পথভ্রষ্টরা বা পথভ্রষ্টকারীই তা অস্বীকার করে থাকে।
হাম্বল ইবন আব্দুল্লাহ রহ. বলেন, আমি আবূ আব্দুল্লাহ (ইমাম আহমাদ) কে কবরের ‘আযাব সম্বন্ধে বললাম, তিনি বললেন, এ সকল হাদীস সহীহ। আমরা এর প্রতি ঈমান রাখি এবং তা স্বীকার করি। যখনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোনো বিশুদ্ধ সনদে হাদীস আসবে আমরা তা স্বীকার করব। তিনি যা নিয়ে এসেছেন আমরা যদি তা স্বীকার না করে ফিরিয়ে দেই তাহলে আমরা যেন আল্লাহর নির্দেশই তার ওপর ফিরিয়ে দিলাম। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ﴾ [الحشر: ٧]
“এবং রাসূল তোমাদের কাছে যা নিয়ে এসছেন তা গ্রহণ কর।” [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ৭]
আমি তাকে বললাম, কবরের ‘আযাব কি সত্য? তিনি বললেন: হ্যাঁ সত্য, কবরে শাস্তি দেওয়া হবে।[2]
শাইখুল ইসলাম তার লিখিত কিতাবের বহু জায়গায় তা উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে ‘‘আল আকীদা আল ওয়াসিতিয়ায়’’ উল্লেখ করে বলেন, পরকালের প্রতি ঈমান আনার মধ্যে মৃত্যুর পরের ঘটনাবলী সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসকল সংবাদ দিয়েছেন তার প্রতি ঈমান আনা। কাজেই কবরের ফিতনা, কবরের শাস্তি ও শান্তির প্রতি তারা ঈমান আনবে। অতঃপর ফিতনা সম্পর্কে বলেন, মানুষ তাদের কবরে ফিতনার সম্মুখীন হবে, প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তোমার রব কে, তোমার দীন কী এবং তোমার নবী কে? আল্লাহ মুমিন বান্দাদেরকে পার্থিব ও পরকালীন জীবনে মজবুত বাক্য দ্বারা শক্তিশালী করেন। মুমিন ব্যক্তি বলবে, আমার রব আল্লাহ, আমার দীন ইসলাম এবং নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর সন্দেহকারী ব্যক্তি বলবে, হায়! হায়! আমি জানি না; কিন্তু লোক মুখে যা শুনেছি আমিও তা বলেছি। তখন তাকে লোহার হাতুড়ী দ্বারা মারা হলে সে এমন ভাবে চিৎকার করবে যে, মানুষ ব্যতীত সকল সৃষ্টি জীবই তা শুনবে। মানুষ যদি তা শুনতো তবে ছিটকে পড়ে যেত।[3]
আল্লামা ত্ব-হাবী আল হানাফী রহ. তার প্রসিদ্ধ সালাফী আকিদায় বলেন, আহলে সুন্নাত ও জামা‘আতগণ কবরের ‘আযাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে সেই ব্যক্তির জন্য যে ব্যক্তি এর উপযোগী এবং কবরে রব, দীন এবং নবী সম্পর্কে মুনকার নাকীর ফিরিশতার প্রশ্ন সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবীদের থেকে প্রাপ্ত খবর অনুপাতে তা সাব্যস্ত করে। কবর হয় জান্নাতের বাগিচা হবে নয়তো জাহান্নামের গুহা হবে।[4]
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম কবরের শাস্তি বা শান্তি সম্পর্কে বলেন, যা জানা উচিৎ তা হলো এই, নিশ্চয় কবরের ‘আযাবই হচ্ছে বারযাখের ‘আযাব। অতঃপর কারোর মৃত্যুর পর যদি ‘আযাবের উপযুক্ত হয়, তবে সে তার অংশ পাবে, চাই তাকে কবর দেওয়া হোক বা না হোক, যদিও তাকে কোনো হিংস্র পশু খেয়ে ফেলে বা আগুনে পুড়ে ছাই করে বাতাসে উড়িয়ে দেওয়া হয় বা শুলে দেওয়া হয়। এমনকি সমূদ্রে ডুবে মারা গেলেও তার শরীর এবং আত্মায় সেই ‘আযাবই পৌঁছাবে, যা কবরে পৌঁছে থাকে।[5]
পৃথিবী এবং আখিরাতের মধ্যবর্তী এ বারযাখে যার মধ্যে এর অধিবাসীগণ পৃথিবী ও আখিরাতের ওপর ভিত্তি করে অবস্থান করবে এবং প্রত্যেকেই তাদের আমল অনুযায়ী বারযাখের ‘আযাব ভোগ করবে, যদিও তাদের শান্তি এবং শাস্তি ভিন্ন হয়। পূর্বে কিছু লোক ধারণা করতো যে, তাদের শরীর যদি আগুনে পুড়ে ছাই করে কিছু অংশ সমূদ্রে, কিছু অংশ প্রবল বাতাসের দিন স্থলে উড়িয়ে দেওয়া হয়, তবে সে তা থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। এ ধারণার ওপর এক লোক তার ছেলেদেরকে অসিয়ত করে বলল, “আমি মারা গেলে আমাকেও এ রকম করে দিবে। (তাকে এ রকম করা হলে) আল্লাহ সমুদ্র এবং মাটিকে নির্দেশ দিলেন তা জমা করার জন্য। তারপর আল্লাহ বললেন, দাঁড়াও! সাথে সাথে তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে গেলে আল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে তোমাকে এ রকম করতে বলেছে? সে বলল, হে আল্লাহ! তুমি তো জান, একমাত্র তোমার ভয়। তখন তিনি নিজ অনুগ্রহে করে তাকে ক্ষমা করে দিলেন।”[6]
সুতরাং বারযাখের শাস্তি ও শান্তি ঐ সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে বাদ পড়বে না যা ছাই হয়ে গিয়েছে। এমনকি যদি প্রবল বাতাসে বৃক্ষের চুড়ায় লাশকে টাঙ্গিয়ে রাখা হয় তবুও বারযাখের শাস্তি বা শান্তি রূহের সাথে শরীরেও পৌঁছাবে।
যদি কোনো পুণ্যবান ব্যক্তিকে আগুনের নিম্ন স্তরেও দাফন করা হয়, তবে সে বারযাখের প্রশান্তির অংশ তার রূহ ও শরীরে পৌঁছাবেই। আল্লাহ তা‘আলা আগুনকে তার জন্য শান্তিদায়ক শীতল করে দিবেন। কারণ, বিশ্বের সকল উপকরণ তার রব এবং সৃষ্টিকর্তার জন্যে নিবেদিত, তিনি যেভাবে চান সে ভাবেই পরিচালনা করেন। তাঁর ইচ্ছার বাহিরে কোনো কিছু অমত প্রকাশ করে না; বরং তাঁর ইচ্ছার অনুগত, তাঁর শক্তির নিকট অনুপ্রাণিত। আর যে কেউ তা অস্বীকার করবে, সে যেন বিশ্বের প্রতিপালককেই অস্বীকার করল, তাঁর সাথে কুফুরি করল এবং তাঁর একত্ববাদকে অস্বীকার করল। তা কিতাব আর রূহ থেকে সংকলন করা হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, বারযাখের বিষয়টি একটি অদৃশ্য বিষয়, যা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর পক্ষে তা বিশ্বাস করা একান্ত আবশ্যক, যেখানে সংক্ষেপাকারে এসেছে সেখানে সংক্ষেপ আর যেখানে বিস্তারিত এসেছে সেখানে বিস্তারিত ভাবেই বিশ্বাস করতে হবে। যেমন কুরআন ও হাদীসে এসেছে সেভাবেই বিশ্বাস করতে হবে। কিন্তু কখনো কখনো আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কতক বান্দার জন্য কবরের অবস্থা প্রকাশ করে দেখিয়ে থাকেন।
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া বলেন, বহু মানুষের জন্য কবরের অবস্থা প্রকাশিত হয়েছে, এমনকি তারা কবরবাসীদের কবরে শাস্তির আওয়াজও শুনতে পেয়েছেন। বহু নিদর্শনসহ স্বচক্ষে তাদের শাস্তি হতে দেখেছে। তবে সর্বদা যে শুধু শরীরেই শাস্তি হতে হবে তা আবশ্যক নয়; বরং তা কখনো শরীরে, কখনো রূহে আবার কখনো উভয়েরই পৌঁছাতে পারে।[7]
দলীল: সহীহ বুখারীতে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বা মাদীনার কোনো এক বাগানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন; এমতাবস্থায় দু’জন লোকের কবরে শাস্তি হতে শুনে বললেন, কবরে তাদের শাস্তি হচ্ছে; কিন্তু কোনো বড় ধরনের পাপের জন্য নয় (এমন পাপের জন্য যা থেকে বেঁচে থাকা কঠিন ছিল না বা তাদের নিকট তা বড় ছিল না[8]) অতঃপর বললেন, হ্যাঁ, বড়ই ছিল (আল্লাহর নিকট তা বড় বা সে পাপ সর্বদা করার কারণে বড় আকার ধারণ করেছে), একজন প্রস্রাব করে পবিত্রতা অর্জন করতো না, অপরজন মানুষের গীবত করে বেড়াতো।”
তারপর একটি খেজুরের ডাল আনতে বললেন, অতঃপর তা দ্বিখণ্ডিত করে প্রত্যেকের কবরে এক টুকরা করে গেড়ে দিলেন। এ রকম করার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, এগুলো শুঁকানো পর্যন্ত হয়তো তাদের শাস্তি কিছুটা হালকা হবে।
ইমাম ত্ব-হাবী রহ. হাসান সনদে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, “আল্লাহর কোনো এক বান্দাকে তার কবরে একশত দুররা মারার নির্দেশ দেওয়া হলে তিনি তার জন্য আল্লাহর নিকট আশ্রয় এবং দো‘আ করতে থাকলেন যতক্ষণ না তা কমিয়ে একটি করা হলো। অতঃপর তার কবরে মাত্র একটি দুররা মারা হলে তার কবর অগ্নিতে ভরপুর হয়ে গেল। যখন তার উপর থেকে আগুন দূর হয়ে গেল তখন সে বলল, কিসের জন্য আমাকে এভাবে মেরেছ? তারা বলল, তুমি একবার বিনা অযুতে সালাত পড়েছিলে এবং নির্যাতিত মানুষের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেছিলে; কিন্তু তাকে সাহায্য কর নি।[9]
এ অধ্যায়ে আরো লক্ষণীয় বিষয় হলো, যা ইবন আবুদ দুনিয়া (কিতাব আল কুবূর) এ উল্লেখ করেছেন, তার নিকট থেকে আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম (কিতাব আর রূহে পৃষ্ঠা নং ৩১৯) নকল করেছেন, একজন দৃঢ় মজবুত তাবেঈ সু‘আইহিদ ইবন জুহাইর থেকে, তিনি বলেন, আমরা আমাদের এবং বসরার মধ্যবর্তী কতগুলো ঝরনার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় একটি গাধার ডাক শুনতে পেলাম, বললাম এ শব্দটি কিসের? তারা বলল, এ শব্দটি এক ব্যক্তির, সে আমাদের সাথে ছিল, একদা তার মা কোনো ব্যাপারে তার সাথে কথা বললে সে বলল, তুমি গাধার মতো চেচাচ্ছ কেন? তারপর সে যখন মারা গেল তখন থেকে প্রতি রাত্রে তার কবর থেকে এ আওয়াজ শুনা যায়।এ ব্যাপারে বহু ঘটনা রয়েছে, জায়গা সংকীর্ণতার দরুন তা উল্লেখ করা হলো না। ঘটনা যাই হোক না কেন ঐ রকম কারণ যদিও দর্শকদের সামনে স্থির কিন্তু এর ভিতরে অন্য রকম। কারণ, এতে যেমন বহু লোক সাজাপ্রাপ্ত এবং বেহুশ হয়ে পড়ে আছে তেমনি বহু লোক হাসি খুশী ও শান্তিতে রয়েছে।