দিল্লির বাদশাহ সম্রাট জাহাঙ্গীরের ন্যায় বিচারে মুগ্ধ হয়ে গেল গোটা রাজ্য


ইতিহাসের পাতায় অনেক অসাধারণ জীবনের গল্পই স্থান পায়। যেসব গল্প মানুষের অন্তরে আলাদা স্থান করে নেয়। আর সেই গল্প যদি হয় রাজা-বাদশাহদের তবে তো আর কথায় নেই। আমাদের এই উপমহাদেশও এক সময় রাজা-বাদশাহদের অধীন ছিল। সেই সব রাজা বাদশাহদের অনেক ইতিহাস ঘটনা আমরা হয়তো শুনেছি। কিছু ইতিহাস আমাদের কাঁদিয়েছে, কিছু ইতিহাস আমাদের হাসিয়েছে আবার কিছু ইতিহাস করেছে অবাক।

আজকে আমরা এমন এক ইতিহাসের গল্প বলবো। যেই গল্পে আছে প্রেম, ধর্ম আর ন্যায়বিচারের অনুপম দৃষ্টান্ত। তখন দিল্লির সিংহাসনের ক্ষমতা ছিল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের। তার পূর্ণ নাম নুরুদ্দীন মুহম্মদ সেলিম । মুঘলদের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ সম্রাট। তিনি প্রায় ২২ বছর রাজত্ব করেন।

বাদশাহ জাহাঙ্গীরের স্ত্রী ছিল বেগম নুর জাহান। নুর জাহান ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী। তাইতো সম্রাট জাহাঙ্গীর তার নাম দেন নূর জাহান। নুর জাহান শব্দের অর্থ জগতের আলো। শুধু রূপের রানী ছিলেন না নুর জাহান, জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, চারুকলা সব কিছুতে সমান পারদর্শী ছিল। উচ্চ শিক্ষিত হওয়ায় তিনি সেই সময় সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী ছিলেন। আতর, গোলাপ পানি তিনি প্রথম তৈরি করেন। সালোয়ার, কুর্তা ও দোপাট্টার হরেক রকম ব্যবহার তিনি চালু করেছিলেন। কবিতা লিখতে বেশ হাত চলতো তার। আর ছিল রাজনীতিতে তার আশ্চর্য দখল। বিশাল মোঘল বাদশাহির শাসন বিষয়েও তিনি বুদ্ধি যোগাতেন বাদশাহ জাহাঙ্গীরকে।

ন্যায় বিচারের দিকে মোগল বাদশাহ ছিল সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি। শহরে শহরে থাকত কাজী। তাদের সবার উপর ছিলেন কাজী উ-কুজ্জাত। কিন্তু বাদশাহর দরবার ছিল সুপ্রিম কোর্ট। দরবারে বসে বাদশাহ নিজেই ফায়সালা করতেন।

বাদশাহ জাহাঙ্গীরের ছিল ন্যায় বিচারের সজাগ দৃষ্টি। বাদশাহ হয়েই তিনি সদর দরজায় একটি শিকল ঝুলিয়ে দিলেন। আর খাস কামরায় একটা ঘন্টা বেঁধে দিলেন তার সাথে। ফরিয়াদি এসে শিকল বাজিয়ে দিতো আর খোদ বাদশাহ নালিশ শুনতেন নিজের কানে। পাইক-পিয়ন, উকিল-মোক্তার কারো দরকার হতো না।

একদিন বেগম নুর জাহান সখীদের নিয়ে তীর ছোঁড়া খেলায় মেতেছেন। তীর খেলে ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় খেলা। তাই তো তার লক্ষ্য ছিল অব্যর্থ ও ভীষণ শক্তিশালী। সেদিন বেগমের তীর খেলায় এক গরীব নিরীহ ধোপার মৃত্যু ঘটে গেল। বেগমের এক তীর আচমকা এসে ধোপার বুকে বেঁধে গেল। বেচারা ধোপা সাথে সাথে মারা গেল। তার দুঃখিনী বউ রক্তমাখা দেহ জড়িয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। ধোপা এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে উঠল কোলাহল, আর্তনাদ আর আহাজারি।

নুর জাহানের এসব খবর নেই। তার তীরে যে কেউ মারা গেছে সেটা তার জানাও ছিল না।  তীর খেলা শেষে সখীদের নিয়ে আনন্দে মেতেছেন। বাদশাহ তার পাশে বসে তার আনন্দ উপভোগ করছে। 

সহসা শিকল সদর দরজার শিকল বেজে উঠল ঝন ঝন ঝন। সবাই থেমে গেল। বাদশাহ উঠে পড়ল, দরবারে যেতে হবে কর্তব্যের ডাক এসেছে। কোন ফরিয়াদি এসেছে নালিশ নিয়ে। আর এক মুহূর্ত দেরী করা চলবে না।

ধোপার বৃদ্ধ বউ সেদিনের ফরিয়াদে। চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে করুন কণ্ঠে বিলাপ করতে করতে বর্ণনা দিলেন কিভাবে ধোপা মারা গেছে। তীরটা এসেছিল অন্দর মহলের দিক থেকেই। আর এমন তেজে এসেছিল যে, কলিজা পর্যন্ত ভেদ করে গিয়েছে।

ধোপার বউ দাবি করল, দোষীকে দরবারে হাজির করা হোক, আর দেশের আইন অনুসারে তার শাস্তির বিধান করা হোক খুনের বদলা খুন। তীরটাও হাজির করা হয়েছিল দরবারে। সবাই সভয়ে দেখল, তীরের মাথায় বেগম নূর জাহান লিখা।

তীর দেখেই বাদশাহ জাহাঙ্গীর দিশেহারা, কি করবেন সহসা ঠিক করতে পারলেন না। তিনি সাত দিন সময় চাইলেন। তাই মেনে নিয়ে চলে গেল ধোপার স্ত্রী কিন্তু আর একবার দাবি জানিয়ে গেল খুনের বদলা খুন ছাড়া আর কোন বিচার সে মেনে নিবে না। বাদশাহ কেবল ভাবে আর ভাবে, খানাপিনা উৎসব শব বন্ধ। ধর্ম ও পতি প্রেমের এক আশ্চর্য বিরোধ। হক বিচার করলে তা নিজের বুকে লাগে আর না করলে ধোপার স্ত্রীর প্রতি করা হবে অন্যায়।

শেষে বাদশাহ মনস্থির করলেন। নুর জাহানকে শাহী কারাগারে আটক করা হবে। সাধারণ কয়েদীর মতই বেগম নুর জাহানের বিচারের অপেক্ষা করতে লাগলো।

সাত দিন পর আবার দরবার বসলো। সাধারণ কয়েদীর মত বেগম নূর জাহান আসামীর কাঠগড়ায় আর ধোপার বউ ফরিয়াদির কাঠগড়ায়। বাদশাহ রায় দিলেন এটা নিয়ে নুর জাহানের স্বামী জাহাঙ্গীরের বুকে সজোরে নিক্ষেপ করবে, যাতে তার কলিজা ভেদ করে সাথে সাথে মৃত্যু ঘটে ঠিক হতভাগ্য ধরার মতো। এর ফলে নুর জাহান হবে ধোপার বউয়ের মতো বিধবা আর বিধবা হওয়ার কষ্ট তিনিও মর্মে মর্মে অনুভব করবে। বাদশাহ তীরটি নিয়ে ধোপার স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললেন, নাও তোমার খুনের বদলা খুন।

সমস্ত দরবার নিস্তব্ধ। নূর জাহান মূর্ছা যাওয়ার মত। ধোপার বউ কাঁপতে লাগলো, ধীরে ধীরে নেমে এলো ফরিয়াদের কাঠগড়া থেকে। এরপর কাঁপতে কাঁপতে ভাঙ্গা গলায় বলল মহামান্য বাদশাহ আমি এ বিচার চাই না। আমি বিধবা হয়েছি বটে কিন্তু ইয়াতিম হতে চাইনি। আমার স্বামী শুধু আমারই আহার যোগাতো আর আমারই আশ্রয় ছিল। কিন্তু মহামান্য বাদশাহ সারা দেশের লোকের মা-বাপ পরম আশ্রয়। আমি সারাদেশকে ইয়াতিম করতে চাই না। বেগম দীর্ঘজীবী হন. আমি আমার দাবি ফিরিয়ে নিচ্ছি। 

আবার দরবারে যেন প্রাণ ফিরে পেল, সবাই বাদশাহর বিচার আর ধোপার বউয়ের দাবি ফিরিয়ে নেয়ার জন্য প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠল।

বাদশাহ বহু টাকা দিয়ে ধোপার বউকে বিদায় করলেন।

দ্বীনি কথা শেয়ার করে আপনিও ইসলাম প্রচারে অংশগ্রহণ করুন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *