রমজানের মাসআলা ,মাসায়েল ও ১০ দিনের বিশেষ আমল!


রোজার মাসয়ালা-মাসায়েল জেনে নিন

মাসআলা: প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্ক বালেগ মুসলিমের উপর রমযানের রোযা ফরয। -সূরা বাকারা : ১৮৫; রদ্দুল মুহতার ২/৩৭২
মাসআলা: শাবানের ২৯ তারিখ দিবাগত সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে পরদিন থেকে রোযা রাখতে হবে। নতুবা শাবানের ৩০ দিন পূর্ণ করার পর রোযা রাখা শুরু করবে। -সহীহ মুসলিম ১/৩৪৭
মাসআলা: আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে রোযা শুরুর জন্য এমন একজন ব্যক্তির চাঁদ দেখাই যথেষ্ট হবে, যার দ্বীনদার হওয়া প্রমাণিত কিংবা অন্তত বাহ্যিকভাবে দ্বীনদার। -মুসতাদরাকে হাকিম ১/৪২৪; রদ্দুল মুহতার ২/৩৮৫
মাসআলা: আকাশ পরিষ্কার থাকলে একজনের খবর যথেষ্ট নয়; বরং এত লোকের খবর প্রয়োজন, যার দ্বারা প্রবল বিশ্বাস জন্মে যে, চাঁদ দেখা গেছে। কেননা, যে বিষয়ে অনেকের আগ্রহ ও সংশ্লিষ্টতা থাকে তাতে দু’ একজনের খবরের উপর নির্ভর করা যায় না।- রদ্দুল মুহতার ৩/৩৮৮

রমজানুল মোবারক এর ফযিলত ও বৈশিষ্ট্য

মাসআলা: কোনো ব্যক্তি একাকী চাঁদ দেখেছে, কিন্তু তার সাক্ষ্য গৃহিত হয়নি, এক্ষেত্রে তার জন্য ব্যক্তিগতভাবে রোযা রাখা উত্তম, জরুরি নয়। এমন ব্যক্তির জন্য রোযা রাখা জরুরি না হলেও উত্তম হল রোযা রাখা। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/১৬৮; বাদায়েউস সানায়ে ২/২২১
মাসআলা: শাবান মাসের ২৯ ও ৩০ তারিখে রোযা রাখবে না; না রমযানের নিয়তে না নফলের নিয়তে। অবশ্য যে পূর্ব থেকেই কোনো নির্দিষ্ট দিবসে (যেমন, সোম ও মঙ্গলবার) নফল রোযা রেখে আসছে, আর ঘটনাক্রমে শাবানের ২৯ ও ৩০ তারিখে ঐ দিন পড়েছে তার জন্য এই তারিখেও নফল রোযা রাখা জায়েয। -সহীহ বুখারী হাদীস: ১৯১; বাদায়েউস সানায়ে ২/২১৭

রোজার মাসয়ালা-মাসায়েল

• নিয়ত

মাসআলা: রোযার নিয়ত করা ফরয। নিয়ত অর্থ সংকল্প। যেমন মনে মনে এ সংকল্প করবে, আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আগামী কালের রোযা রাখছি। মুখে বলা জরুরি নয়।- সহীহ বুখারী ১/২; বাদায়েউস সানায়ে ২/২২৬

মাসআলা: ফরয রোযার নিয়ত রাতেই করা উত্তম। -সুনানে আবু দাউদ ১/৩৩৩; বাদায়েউস সানায়ে ২/২২৯

মাসআলা: রাতে নিয়ত করতে না পারলে দিনে সূর্য ঢলার প্রায় এক ঘণ্টা আগে নিয়ত করলেও রোযা হয়ে যাবে।-সহীহ বুখারী ২০০৭; বাদায়েউস সানায়ে ২/২২৯

মাসআলা: পুরো রমযানের জন্য একত্রে নিয়ত করা যথেষ্ট নয়; বরং প্রত্যেক রোযার নিয়ত পৃথক পৃথকভাবে করতে হবে। কারণ প্রতিটি রোযা ভিন্ন ভিন্ন আমল (ইবাদত)। আর প্রতিটি আমলের জন্যই নিয়ত করা জরুরি। -সহীহ বুখারী ১/২; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৯৫

মাসআলা: রাতে রোযার নিয়ত করলেও সুবহে সাদিক পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী-মিলনের অবকাশ থাকে। এতে নিয়তের কোনো ক্ষতি হবে না। -সূরা বাকারা : ১৮৭

মাসআলা: নিয়তের সময় শুরু হয় পূর্বের দিনের সূর্যাস্তের পর থেকে। যেমন-মঙ্গলবারের রোযার নিয়ত সোমবার দিবাগত রাত তথা সূর্যাস্তের পর থেকে করা যায়। সোমবার সূর্যাস্তের পূর্বে মঙ্গলবারের রোযার নিয়ত করা যথেষ্ট নয়। কেননা, হাদীস শরীফে রাতে নিয়ত করার কথা বলা হয়েছে। -আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৪৩; রদ্দুলমুহতার ২/৩৭৭

• সাহরী

মাসআলা: সাহরী খাওয়া সুন্নত। পেট ভরে খাওয়া জরুরি নয়, এক ঢোক পানি পান করলেও সাহরীর সুন্নত আদায় হবে।-সহীহ মুসলিম ১/৩৫০

মাসআলা: সুবহে সাদিকের কাছাকাছি সময় সাহরী খাওয়া মুস্তাহাব। তবে এত দেরি করা মাকরূহ যে, সুবহে সাদিক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়। -আলমুজামুল আওসাত ২/৫২৬

মাসআলা: দেরি না করে সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা মুস্তাহাব।-সহীহ বুখারী ১/২৬৩

মাসআলা: মাগরিবের নামায পড়ার আগেই ইফতার করে নিবে, যেন সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করার সওয়াব পাওয়া যায়। -সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৬৯২

মাসআলা: খেজুর দ্বারা ইফতার করা মুস্তাহাব। খেজুর না পেলে পানি দ্বারা ইফতার করবে। -সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৬৯৪ ইফতারের সময় দুআ

মাসআলা: ইফতারের সময় দুআ কবুল হয় তাই এ সময় বেশি বেশি দুআ-ইস্তিগফার করতে থাকবে। বিশেষত এই দুআ করবে-

اَللهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ بِرَحْمَتِكَ الَّتِيْ وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ أَنْ تَغْفِرَ لِيْ

অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তোমার সেই রহমতের উসীলায় প্রার্থনা করছি যা সকল বস্তুকে পরিবেষ্টিত, তুমি আমাকে মাফ করে দাও। -সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস নং ১৭৫৩

আর ইফতার গ্রহণের সময় এ দুআ পড়বে-

اَللهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَعَلىٰ رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ.

অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমার জন্যই রোযা রেখেছিলাম এবং তোমার রিযিক দ্বারাই ইফতার করলাম। -সুনানে আবু দাউদ হাদীস: ২৩৫৮

ইফতারের পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দুআ পড়তেন,

ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوْقُ وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللهُ.

অর্থ: পিপাসা দূর হল, শিরা-উপশিরা সতেজ হল আর আল্লাহ তাআলা চান তো রোযার সওয়াব লিপিবদ্ধ হল। -সুনানে আবু দাউদ ১/৩২১, হাদীস: ২৩৫৭

যেসব কারণে রোযা ভেঙ্গে যায় এবং কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরি হয়
মাসআলা: রমযানে রোযা রেখে দিনে স্ত্রী সহবাস করলে বীর্যপাত না হলেও স্বামী-স্ত্রী উভয়ের উপর কাযা ও কাফফারা ওয়াজিব হবে। -সহীহ বুখারী ৬৭০৯

মাসআলা: রোযা রেখে স্বাভাবিক অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরি হবে। -সুনানে দারাকুতনী ২/১৯১; আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৬

মাসআলা: বিড়ি-সিগারেট, হুক্কা পান করলেও রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরি হবে। -রদ্দুল মুহতার ৩/৩৮৫

মাসআলা: সুবহে সাদিক হয়ে গেছে জানা সত্ত্বেও আযান শোনা যায়নি বা এখনো ভালোভাবে আলো ছাড়ায়নি এ ধরনের ভিত্তিহীন অজুহাতে খানাপিনা করলে বা স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হলে কাযা-কাফফারা দু’টোই জরুরি হবে। -সূরা বাকারা : ১৮৭; মাআরিফুল কুরআন ১/৪৫৪-৪৫৫

কাফফারা আদায়ের নিয়ম – মাসয়ালা-মাসায়েল

মাসআলা: একটি রোযার জন্য দুই মাস ধারাবাহিকভাবে রোযা রাখতে হবে। কোনো কারণে ধারাবাহিকতা ছুটে গেলে পুনরায় নতুন করে রোযা রাখতে হবে। পেছনের রোযাগুলো কাফফারার রোযা হিসাবে ধর্তব্য হবে না। তবে মহিলাদের হায়েযের কারণে ধারাবাহিকতা নষ্ট হলে অসুবিধা নেই। -আলমুহাল্লা ৪/৩৩১; আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৭

যেসব কারণে রোযা ভেঙ্গে যায় এবং শুধু কাযা করতে হয়

মাসআলা: অযু বা গোসলের সময় রোযার কথা স্মরণ থাকা অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। তাই রোযা অবস্থায় অযু-গোসলের সময় নাকের নরম স্থানে পানি পৌঁছানো এবং গড়গড়াসহ কুলি করবে না। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৩৬৩; ফাতাওয়া শামী ২/৪০১

মাসআলা: যা সাধারণত আহারযোগ্য নয় বা কোনো উপকারে আসে না, তা খেলেও রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা করতে হবে। -সহীহ বুখারী ১/২৬০ (তা’লীক); রদ্দুল মুহতার ২/৪১০

মাসআলা: দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে যদি তা থুথুর সাথে ভেতরে চলে যায় তবে রক্তের পরিমাণ থুথুর সমান বা বেশি হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। -রদ্দুল মুহতার ২/৩৯৬

মাসআলা: হস্তমৈথুনে বীর্যপাত হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। আর এটা যে ভয়াবহ গুনাহের কাজ তা বলাই বাহুল্য। -সহীহ বুখারী ১/২৫৪; ফাতাওয়া শামী ২/৩৯৯

মাসআলা: মুখে বমি চলে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেললে রোযা ভেঙ্গে যাবে। যদিও তা পরিমাণে অল্প হয়। আদ্দুররুল মুখতার ২/৪১৫

মাসআলা: রোযা অবস্থায় হায়েয বা নেফাস শুরু হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। পরে তা কাযা করতে হবে। -সহীহ বুখারী ১/৪৪; আননুতাফ ফিল ফাতাওয়া ১০০

মাসআলা: পেটের এমন ক্ষতে ওষুধ লাগালে রোযা ভেঙ্গে যাবে, যা দিয়ে ওষুধ পেটের ভেতর চলে যায়। বিশেষ প্রয়োজনে এমন ক্ষতে ওষুধ লাগাতে হলে পরে সে রোযার কাযা করে নিতে হবে। -রদ্দুল মুহতার ২/৪০২

মাসআলা: নাকে ওষুধ বা পানি দিলে তা যদি গলার ভেতরে চলে যায় তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা করতে হবে।

মাসআলা: মলদ্বারের ভেতর ওষুধ বা পানি ইত্যাদি গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। -রদ্দুল মুহতার ২/৪০২

মাসআলা: সুবহে সাদিকের পর সাহরীর সময় আছে ভেবে পানাহার বা স্ত্রীসঙ্গম করলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। তেমনি ইফতারির সময় হয়ে গেছে ভেবে সূর্যাস্তের পূর্বে ইফতার করে নিলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। -আলবাহরুর রায়েক ২/২৯১

মাসআলা: রোযা রাখা অবস্থায় ভুলবশত পানাহার করে রোযা নষ্ট হয়ে গেছে ভেবে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে এবং কাযা করা জরুরি হবে।

মাসআলা: অনিচ্ছাকৃত বমি হওয়ার কারণে রোযা নষ্ট হয়ে গেছে মনে করে রোযা ভেঙ্গে ফেললে কাযা করতে হবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৪৯; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৫০; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪০১

যেসব কারণে রোযা ভাঙে না – মাসয়ালা-মাসায়েল

এমন কিছু কাজ আছে, যার দ্বারা রোযার কোনো ক্ষতি হয় না। অথচ অনেকে এগুলোকে রোযা ভঙ্গের কারণ মনে করে। ফলে এমন কোনো কাজ হয়ে গেলে রোযা ভেঙে গেছে মনে করে ইচ্ছাকৃত পানাহার করে। পক্ষান্তরে কেউ কেউ এসব কাজ পরিহার করতে গিয়ে অযথা কষ্ট ভোগ করে। সুতরাং এসব বিষয়েও সকল রোযাদার অবগত হওয়া জরুরি।

মাসআলা: কোনো রোযাদার রোযার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার করলে তার রোযা নষ্ট হবে না। তবে রোযা স্মরণ হওয়া মাত্রই পানাহার ছেড়ে দিতে হবে। -সহীহ মুসলিম ১/২০২; আলবাহরুর রায়েক২/২৭১

মাসআলা: চোখে ওষুধ-সুরমা ইত্যাদি লাগালে রোযার কোনো ক্ষতি হয় না। -সুনানে আবু দাউদ ১/৩২৩; রদ্দুল মুহতার ২/৩৯৫

মাসআলা: রাত্রে স্ত্রীসহবাস করলে বা স্বপ্নদোষ হলে সুবহে সাদিকের আগে গোসল করতে না পারলেও রোযার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে কোনো ওযর ছাড়া, বিশেষত রোযার হালতে দীর্ঘ সময় অপবিত্র থাকা অনুচিত।

মাসআলা: বীর্যপাত ঘটা বা সহবাসে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে স্ত্রীকে চুমু খাওয়া জায়েয। তবে কামভাবের সাথে চুমু খাওয়া যাবে না। আর যুবকদের যেহেতু এমন আশঙ্কা থাকে তাই তাদের বেঁচে থাকা উচিত। -মুসনাদে আহমদ ২/১৮০, ২৫০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০০

মাসআলা: অনিচ্ছাকৃত বমি হলে (মুখ ভরে হলেও) রোযা ভাঙ্গবে না। তেমনি বমি মুখে এসে নিজে নিজে ভেতরে চলে গেলেও রোযা ভাঙ্গবে না। -জামে তিরমিযী হাদীস: ৭২০; রদ্দুল মুহতার ২/৪১৪

মাসআলা: শরীর বা মাথায় তেল ব্যবহার করলে রোযা ভাঙ্গবে না। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/৩১৩; আলবাহরুর রায়েক ২/১৭৩

মাসআলা: শুধু যৌন চিন্তার কারণে বীর্যপাত হলে রোযা ভাঙ্গবে না। তবে এ কথা বলাই বাহুল্য যে, সব ধরনের কুচিন্তা তো এমনিতেই গুনাহ আর রোযার হালতে তো তা আরো বড় অপরাধ। -রদ্দুল মুহতার ২/৩৯৬

মাসআলা: কামভাবের সাথে কোনো মহিলার দিকে তাকানোর ফলে কোনো ক্রিয়া-কর্ম ছাড়াই বীর্যপাত হলে রোযা ভাঙ্গবে না। তবে রোযা অবস্থায় স্ত্রীর দিকেও এমন দৃষ্টি দেওয়া অনুচিত। আর অপাত্রে কু-দৃষ্টি তো গুনাহ। যা রোযা অবস্থায় আরো ভয়াবহ। এতে ঐ ব্যক্তি রোযার ফযীলত ও বরকত থেকে মাহরূম হয়ে যায়। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/২৫৯; ফাতাওয়া শামী ২/৩৯৬

মাসআলা: মশা-মাছি, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি অনিচ্ছাকৃত পেটের ভেতর ঢুকে গেলেও রোযা ভাঙ্গবে না।

মাসআলা: অনুরূপ ধোঁয়া বা ধুলোবালি অনিচ্ছাকৃতভাবে গলা বা পেটের ভেতর ঢুকে গেলে রোযা ভাঙ্গবে না। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/৩৪৯; রদ্দুল মুহতার ২/৩৯৫

মাসআলা: স্বপ্নদোষ হলে রোযা ভাঙ্গবে না। -সুনানে কুবরা, বাইহাকী ৪/২৬৪

মাসআলা: চোখের দু’ এক ফোটা পানি মুখে চলে গেলে রোযার ক্ষতি হয় না। তবে তা যদি গলার ভেতর চলে যায় তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। -আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৪৯

মাসআলা: সুস্থ অবস্থায় রোযার নিয়ত করার পর যদি অজ্ঞান বা অচেতন হয়ে যায় তাহলে রোযা নষ্ট হবে না। -সুনানে কুবরা, বাইহাকী ৪/২৩৫;

যাদের জন্য রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে

১. মুসাফির

মাসআলা: মুসাফিরের জন্য সফরের হালতে রোযা না রাখার সুযোগ রয়েছে। তবে অস্বাভাবিক কষ্ট না হলে রোযা রাখাই উত্তম। আর অস্বাভাবিক কষ্ট হলে রোযা রাখা মাকরূহ। এ অবস্থায় রোযা না রেখে পরে তা কাযা করবে। – মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৩২; রদ্দুল মুহতার ২/৪২১

মাসআলা: সফরের হালতে রোযা রাখা শুরু করলে তা আর ভাঙ্গা জায়েয নয়। কেউ ভেঙ্গে ফেললে গুনাহগার হবে। তবে কাফফারা আসবে না। শুধু কাযাই যথেষ্ট। -রদ্দুল মুহতার ২/৪৩১

মাসআলা: মুসাফির সফরের কারণে রোযা রাখেনি, কিন্তু দিন শেষ হওয়ার আগেই মুকীম হয়ে গেল। তাহলে দিনের অবশিষ্ট সময় রমযানের মর্যাদা রক্ষার্থে পানাহার থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব। তবে পরবর্তী সময়ে এ রোযার কাযা অবশ্যই করতে হবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/২২১; আলবাহরুর রায়েক ২/২৯১

মাসআলা: রমযানের দিনে হায়েয-নেফাস থেকে পবিত্র হলে অবশিষ্ট দিন রমযানের মর্যাদা রক্ষার্থে পানাহার থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব। তবে উক্ত ওযরে ছুটে যাওয়া রোযাগুলোর সাথে এ দিনের রোযাও কাযা করবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/২২১; আলবাহরুর রায়েক ২/২৯১

২. অসুস্থ ব্যক্তি

মাসআলা: রোযার কারণে যে রোগ বৃদ্ধি পায় বা রোগ-ভোগ দীর্ঘ হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে সে রোগে রোযা ভাঙ্গার অবকাশ আছে। উল্লেখ্য, আশঙ্কা যদি সুস্পষ্ট হয় তাহলে তো কথা নেই। নতুবা একজন অভিজ্ঞ ও দ্বীনদার চিকিৎসকের মতামতের প্রয়োজন হবে। -আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৫৯

৩. গর্ভবতী

মাসআলা: রোযা রাখার কারণে গর্ভবতী মহিলা নিজের কিংবা সন্তানের প্রাণহানী বা মারাত্মক স্বাস্থ্যহানীর প্রবল আশঙ্কা করলে তার জন্য রোযা ভঙ্গ করা জায়েয। পরে এ রোযা কাযা করে নিবে। -আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৫৯

৪. দুগ্ধদানকারিনী

মাসআলা: দুগ্ধদানকারিনী মা রোযা রাখলে যদি সন্তান দুধ না পায় আর ঐ সন্তান অন্য কোনো খাবারেও অভ্যস্ত না হয়, ফলে দুধ না পাওয়ার কারণে সন্তানের মৃত্যুর বা মারাত্মক স্বাস্থ্যহানীর আশঙ্কা হয়, তাহলে তিনি রোযা ভাঙ্গতে পারবেন এবং পরে কাযা করে নিবেন। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, অর্থ: আল্লাহ তাআলা মুসাফিরের জন্য রোযার হুকুম শিথিল করেছেন এবং আংশিক নামায কমিয়ে দিয়েছেন। আর গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিনীর জন্যও রোযার হুকুম শিথিল করেছেন। -জামে তিরমিযী ১/১৫২; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৫৯

৫. দুর্বল বৃদ্ধ ব্যক্তি

মাসআলা: বার্ধক্যজনিত কারণে রোযা রাখতে সক্ষম না হলে রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে। তবে সে ফিদয়া দিবে। -সূরা বাকারা : ১৮৪; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৬১

ফিদয়া

মাসআলা: ফিদয়া হল প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে একজন গরীবকে দুবেলা খাবার খাওয়ানো অথবা পৌনে দু কেজি গমের মূল্য সদকা করা। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৭৫৮৫;

মাসআলা: যে বৃদ্ধ বা অসুস্থ ব্যক্তির রোযা রাখার সামর্থ্য নেই এবং পরবর্তীতে কাযা করতে পারবে এমন সম্ভাবনাও নেই এমন ব্যক্তি রোযার পরিবর্তে ফিদয়া প্রদান করবে। -সূরা বাকারা : ১৮৪

মাসআলা: যাদের জন্য রোযার পরিবর্তে ফিদয়া দেওয়ার অনুমতি রয়েছে তারা রমযানের শুরুতেই পুরো মাসের ফিদয়া দিয়ে দিতে পারবে। -আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৭; আলবাহরুর রায়েক ২/২৮৭

মাসআলা: উপরোক্ত দুই শ্রেণীর মানুষ ছাড়া (অর্থাৎ দুর্বল বৃদ্ধ ও এমন অসুস্থ ব্যক্তি যার ভবিষ্যতে রোযার শক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।) আরো যাদের জন্যে রোযা ভাঙ্গা জায়েয আছে, (যেমন-মুসাফির, গর্ভবতী ও শিশুকে স্তন্যদানকারিনী) তারা রোযা না রাখলে রোযার ফিদয়া দিবে না; বরং পরে কাযা করবে। আর ওযরের হালতে মৃত্যুবরণ করলে কাযা ও ফিদয়া কিছুই ওয়াজিব হবে না। অবশ্য ওযরের হালত শেষ হওয়ার পর, অর্থাৎ মুসাফির মুকীম হওয়ার পর, গর্ভবতী নারীর সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া ও ¯্রাব বন্ধ হওয়ার পর এবং স্তন্যদানকারিনী স্তন্যদান বন্ধ করার পর যদি মৃত্যুবরণ করে তাহলে ওযর শেষে যে কয়দিন সময় পেয়েছে সে কয়দিনের কাযা যিম্মায় আসবে। কাযা না করলে উক্ত দিনগুলির ফিদয়া প্রদানের অসিয়ত করে যেতে হবে। -আদ্দুররুল মুখতার ২/৪২৩-৪২৪; কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনাহ ১/২৫৫

মাসআলা: ছুটে যাওয়া রোযার কাযা সম্ভব না হলে মৃত্যুর পূর্বে ফিদয়া দেওয়ার অসিয়ত করে যাওয়া জরুরি। অসিয়ত না করে গেলে ওয়ারিশরা যদি মৃতের পক্ষ থেকে ফিদয়া দেয় তবে আশা করা যায় যে, আল্লাহ তাআলা তা কবুল করবেন। তবে মৃতব্যক্তি অসিয়ত না করে গেলে সে ক্ষেত্রে মিরাসের ইজমালী সম্পদ থেকে ফিদয়া দেওয়া যাবে না। একান্ত দিতে চাইলে বালেগ ওয়ারিশগণ তাদের অংশ থেকে দিতে পারবে। -রদ্দুল মুহতার ২/৪২৪-৪২৫

মাসআলা: এক রোযার ফিদয়া একজন মিসকীনকে দেওয়া উত্তম। তবে একাধিক ব্যক্তিকে দিলেও ফিদয়া আদায় হয়ে যাবে। আর একাধিক ফিদয়া এক মিসকীনকে দেওয়া জায়েয। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৭৫৭৪; আলবাহরুর রায়েক ২/৮৭

রোযা মাকরূহ হওয়ার কারণসমূহ

মাসআলা: রোযা অবস্থায় কুলি করার সময় গড়গড়া করা এবং নাকের নরম অংশ পর্যন্ত পানি পৌঁছানো মাকরূহ। -জামে তিরমিযী, হাদীস: ৭৬৬; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৯৯

মাসআলা: এমন কাজ করা মাকরূহ, যার দ্বারা রোযাদার নিতান্তই দুর্বল হয়ে পড়ে। যেমন শিঙ্গা লাগানো। -সুনানে তিরমিযী ৭৭৮; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০০

মাসআলা: রোযা অবস্থায় শরীর থেকে রক্ত বের হলে বা ইনজেকশন ইত্যাদি দ্বারা রক্ত বের করলে রোযা ভাঙ্গবে না। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে এ পরিমাণ রক্ত বের করা মাকরূহ, যার দ্বারা রোযাদার খুব দুর্বল হয়ে যায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৪০; রদ্দুল মুহতার ২/৩৯৫

মাসআলা: রোযার হালতে গীবত করলে, গালি-গালাজ করলে, টিভি-সিনেমা ইত্যাদি দেখলে, গান-বাদ্য শ্রবণ করলে এবং যে কোনো বড় ধরনের গুনাহে লিপ্ত হলে রোযা মাকরূহ হয়ে যায়। আর এ কাজগুলো যে সর্বাবস্থায় হারাম, তা তো বলাই বাহুল্য।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০৪; যেসব কাজ রোযাদারের জন্য মাকরূহ নয়

মাসআলা: রোযার হালতে প্রয়োজনে জিহবা দ্বারা কোনো কিছুর স্বাদ নেওয়া বা প্রয়োজনে বাচ্চাদের জন্য খাদ্য চিবানো মাকরূহ নয়। তবে সতর্ক থাকতে হবে, যেন স্বাদ গলার ভেতরে চলে না যায়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/২০৭; রদ্দুল মুহতার ২/৪১৬

মাসআলা: রোযাদারের জন্য সুরমা লাগানো বা সুগন্ধি ব্যবহার করা মাকরূহ নয়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/২০৮; আলবাহরুর রায়েক ২/২৮০

মাসআলা: রোযা অবস্থায়ও মিসওয়াক করা সুন্নত। এমনকি কাঁচা ডাল দ্বারা মিসওয়াক করাও মাকরূহ নয়। -সহীহ বুখারী ১/২৫৯


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *