ইসলামে মৃত মানুষদের কেমন সম্মান দেওয়া হয় ?


ইসলামে মৃত মানুষের সম্মান

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের পর থেকে গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের মৃত্যুহার। সংক্রামক ব্যাধিটি মৃত ব্যক্তি থেকে ছড়িয়ে পড়ার কোনো তথ্য আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে এখনো পাওয়া যায়নি। বরং সুরক্ষিতভাবে দাফনকার্য সমাপ্তের জন্য সংস্থার পক্ষ থেকে অবশ্য পালনীয় কিছু নীতিমালা প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, অনেকে মৃত মুসলিমের গোসল ও কাফন-দাফনের ব্যবস্থার ব্যাপারে অবহেলা করছেন।

আবার অনেকে মৃতের দেহকে পুড়িয়ে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন, যা ইসলামী শরিয়াহ মতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। অথচ মৃতের দাফনকার্য সম্পর্কে ইসলামে সুস্পষ্ট নীতিমালা আছে। মানুষ হিসেবে মৃত ব্যক্তির সম্মান সুনিশ্চিত করা ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

মানবজাতির সম্মান : সৃষ্টিকুলের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাবান প্রাণী হলো মানুষ। মানবজাতির প্রতি সম্মান জানিয়ে পৃথিবীতে মানুষের প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি আদমের সন্তানকে সম্মান দিয়েছি, স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের জন্য বাহন দিয়েছি, তাদের উত্তম রিজিক দিয়েছি এবং যাদের সৃষ্টি করেছি, তাদের অনেকের ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৭০)

মৃত্যুর পর মানুষের সম্মান : ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদা শুধু জীবিত থাকাকালেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং মৃত্যুর পরও এ সম্মান অব্যাহত থাকবে। ইসলামী শরিয়ায় মানুষ হলো এক অনন্য সৃষ্টি, সে জীবিত হোক বা মৃত—একই সম্মান ও মর্যাদা লাভ করবে। তাই ইসলামী আইনের একটি নীতি হলো, ‘মানবসন্তান জীবিত বা মৃত হোক সম্মানের পাত্র বলে গণ্য হবে।’ (আল মাবসুত, ৫৯/২)

তাই ‘সতর’ তথা নারী ও পুরুষের সুনির্দিষ্ট অঙ্গ ঢেকে রাখা জীবিত মানুষের অন্যতম ভূষণ, তেমনি মৃত্যুর পরও গোসলের সময় সতর ঢেকে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাতে মৃত ব্যক্তির সম্মান মৃত্যুর পরও অটুট থাকে। অতএব, অপ্রয়োজনে মৃতদেহ বিকৃত করা বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা ইসলামী শরিয়া মতে নিষিদ্ধ।

মৃতের প্রতি জীবিতের দায়িত্ব : ইসলামী শরিয়তে দাফনের আগ পর্যন্ত মৃতের দৈহিক মর্যাদা সুনিশ্চিত করা জীবিতদের দায়িত্ব। তেমনি দাফনের পর কবরস্থানের দেখাশোনা করাও সবার কর্তব্য। জীবিতাবস্থার মতো মারা যাওয়ার পরও মৃতদেহের সম্মান ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা জীবিতদের কর্তব্য। তাই মৃত ব্যক্তিকে সযত্নে কাফন দেওয়া, জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থা করা মুসলিম সমাজের অত্যাবশ্যকীয় একটি বিধান। মৃতদের কবর দেওয়ার স্থানও সংরক্ষণ করা অতি জরুরি। কবরস্থানের অসম্মান হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি তাকে (মানুষকে) মৃত করেন এবং কবরস্থ করেন।’ (সুরা : আবাসা, আয়াত : ২১)

মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়া : গোসল মৃত ব্যক্তির অন্যতম অধিকার। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম আদম (আ.)-কে মৃত্যুর পর ফেরেশতারা গোসল দিয়েছেন। জীবিতদের জন্য তা অনেক বড় সওয়াবের কাজ। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, “আদম (আ.)-কে ফেরেশতারা পানি ও বরইপাতা দিয়ে গোসল দিয়েছেন। তারা তাঁকে কাফন দিয়েছে, ‘লাহদ’ কবরে তাঁকে দাফন করেছে এবং তারা বলেছে, হে আদমের সন্তানরা, মৃতদের ব্যাপারে এটা তোমাদের সুন্নত তথা করণীয়।” (তাবরানি, হাদিস ৮২৬১)

কবর খনন সওয়াবের কাজ : মৃত ব্যক্তির জন্য কবর খনন করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। খননকারীর জন্য তা প্রভূত সওয়াব বয়ে আনে। তেমনি গোসল দেওয়া, দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে মৃতের গোসল দেয় ও তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে, আল্লাহ তাকে ৪০ বার ক্ষমা করেন। আর যে ব্যক্তি মৃতকে কাফন পরায়, আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতের রেশমের কাপড় পরিধান করাবেন। যে ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির জন্য কবর খনন করে তাতে কবর দেয়, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামত পর্যন্ত মৃতের জন্য ঘরের বসবাসের ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিদান দেন।’ (মুসতাদরাকে হাকিম, ১/৫০৫)

কবরস্থানের সম্মান নিশ্চিত করা : কবরের ওপর বসা ও মলমূত্র ত্যাগ করা অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। কেননা এতে করে মৃতদের অবজ্ঞা করা হয়। এমনকি কবরের ওপর দিয়ে হাঁটা-চলা করা ও হেলান দেওয়াও নিষিদ্ধ। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) কবরকে প্লাস্টার করতে, কবরে লিখতে, তার ওপর দালান নির্মাণ ও হাঁটা-চলা করতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসলিম, হাদিস ৮৯১১)

কবরের ওপর বসা নিষেধ : অন্য হাদিসে এসেছে, আমর বিন হিজাম (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) আমাকে কবরের ওপর হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখে বলেন, ‘তুমি কবরের অধিবাসীকে কষ্ট দিয়ো না বা তোমরা তাকে কষ্ট দিয়ো না।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ৮৯০৬)

কবর থেকে চুরি করা পাপ :  কবর দেওয়ার পর আবার কবর খুঁড়ে মৃতদেহ থেকে কাফন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ইত্যাদি কেটে নেওয়া জঘন্য পাপ। নতুন কবরের ক্ষেত্রে অনেক চোর এমনটি করে থাকে। তবে অপ্রয়োজনে এমন কাজ করা বড় গোনাহ। কেননা

এর দ্বারা মৃত ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করা হয়। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমাদের মৃতদের যে চুরে করে, সে

যেন আমাদের জীবিত করল।’ (নাসবুর রায়াহ, ৩৭৬/৩)

মৃতদের গালমন্দ করা নিষিদ্ধ : ইসলামে মৃতদের গালমন্দ করাও নিষিদ্ধ। তাই মৃত ব্যক্তিকে তিরস্কার করা, দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা বা অযাচিত কথা বলা গোনাহর কাজ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মৃতদের গালমন্দ কোরো না, তারা যা করেছে তারা তা পেয়েছে।’ (বুখারি, হাদিস ১৩২৯)

এভাবেই ইসলাম মৃত মানুষের মর্যাদা সমুন্নত করেছে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *