রাসূল (ছাঃ)-এর ঈলার ঘটনা


দাম্পত্য জীবন মানুষের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুম্পর্কের মাধ্যমে এ জীবন মধুময় হয়ে ওঠে। আবার দু’জনের মাঝে মনোমালিন্য ও ভুল বোঝাবুঝিতে এ জীবন দুঃখ-যাতনায় ভরে যায়। হাফছাহ (রাঃ) কর্তৃক আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে নবী করীম (ছাঃ)-এর কথা ফাঁস করে দেয়ার কারণে রাসূল (ছাঃ) পত্নীগণের কাছে এক মাস না যাওয়ার শপথ করেন। সে সম্পর্কেই নিম্নোক্ত হাদীছ।-

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বহুদিন ধরে উৎসুক ছিলাম যে, আমি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর নিকট জিজ্ঞেস করব, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণের মধ্যে কোন দু’জনের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেছেন, ‘তোমার দু’জন যদি অনুশোচনা ভরে আল্লাহর দিকে আস (তবে তা তোমাদের জন্য উত্তম), তোমাদের অন্তর (অন্যায়ের দিকে) ঝুঁকে পড়েছে’ (আত-তাহরীম ৬৬/৪)

এরপর একবার ওমর (রাঃ) হজ্জের জন্য রওয়ানা হ’লেন এবং আমিও তাঁর সঙ্গে হজ্জে গেলাম। ফিরে আসার পথে তিনি ইসতিনজার জন্য রাস্তা থেকে সরে গেলেন। আমি পানি পূর্ণ পাত্র হাতে তাঁর সঙ্গে গেলাম। তিনি ইসতিনজা করে ফিরে এলে আমি ওযূর পানি তাঁর হাতে ঢেলে দিতে লাগলাম। তিনি যখন ওযূ করছিলেন, তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, হে আমীরুল মুমিনীন!

নবী করীম (ছাঃ)-এর সহধর্মিনীগণের মধ্যে কোন দু’জন সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘তোমরা দু’জন যদি আল্লাহর কাছে তওবা কর, তবে তোমাদের জন্য উত্তম। কেননা তোমাদের মন সঠিক পথ থেকে সরে গেছে’। জবাবে তিনি বললেন, হে ইবনু আববাস! আমি তোমার প্রশ্ন শুনে অবাক হচ্ছি।

তাঁরা দু’জন তো আয়েশা (রাঃ) ও হাফছাহ (রাঃ)। এরপর ওমর (রাঃ) এ ঘটনাটি বর্ণনা করলেন, ‘আমি এবং আমার একজন আনছারী প্রতিবেশী যিনি উমাইয়াহ ইবনু যায়েদ গোত্রের লোক; তারা মদীনার উপকণ্ঠে বসবাস করত, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে পালাক্রমে সাক্ষাৎ করতাম। সে একদিন নবী করীম (ছাঃ)-এর দরবারে যেত, আরেক দিন আমি যেতাম। যখন আমি দরবারে যেতাম, ঐ দিন দরবারে অহী অবতীর্ণসহ যা ঘটত সবকিছুর খবর আমি তাকে দিতাম এবং সেও তেমনি খবর আমাকে দিত।

আমরা কুরাইশরা নিজেদের স্ত্রীগণের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিলাম। কিন্তু আমরা যখন আনছারদের মধ্যে আসলাম, তখন দেখতে পেলাম, তাদের স্ত্রীগণ তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে আছে এবং তাদের উপর কর্তৃত্ব করে চলেছে। সুতরাং আমাদের স্ত্রীরাও তাদের দেখাদেখি সেরূপ ব্যবহার করতে লাগল।

একদিন আমি আমার স্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্ট হ’লাম এবং তাকে উচ্চৈঃস্বরে কিছু বললাম। সেও প্রতি উত্তর দিল। আমার কাছে এ রকম প্রতি উত্তর দেয়াটা অপসন্দনীয় হ’ল। সে বলল, আমি আপনার কথার পাল্টা উত্তর দিচ্ছি এতে অবাক হচ্ছেন কেন?

আল্লাহর কসম! নবী করীম (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণ তাঁর কথার মুখে মুখে পাল্টা উত্তর দিয়ে থাকেন এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার একদিন এক রাত পর্যন্ত কথা না বলে কাটান। ওমর (রাঃ) বলেন, এ কথা শুনে আমি ঘাবড়ে  গেলাম এবং আমি বললাম, তাদের মধ্যে যারা এরূপ করেছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরপর আমি আমার কাপড় পরলাম এবং আমার কন্যা হাফছার ঘরে প্রবেশ করলাম। আমি বললাম, হাফছাহ!

তোমাদের মধ্য থেকে কারো প্রতি রাসূল (ছাঃ) কি সারা দিন রাত পর্যন্ত অসন্তুষ্ট থাকেননি? সে উত্তর করল, হ্যাঁ। আমি বললাম, তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছ। তোমরা কি এ ব্যাপারে ভীত হচ্ছ না যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অসন্তুষ্টির কারণে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন? পরিণামে তোমরা ধ্বংসের মধ্যে পড়বে। সুতরাং তুমি নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে অতিরিক্ত কোন জিনিস দাবী করবে না এবং তাঁর কথার প্রতিউত্তর করবে না।

তাঁর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করবে না। তোমার যদি কোন কিছুর প্রয়োজন হয়, তবে আমার কাছে চেয়ে নেবে। আর তোমার সতীন তোমার চেয়ে অধিক রূপবতী এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অধিক প্রিয় তা যেন তোমাকে বিভ্রান্ত না করে। এখানে সতীন বলতে আয়েশা (রাঃ)-কে বুঝানো হয়েছে।

ওমর (রাঃ) আরো বলেন, এ সময় আমাদের মধ্যে এ কথা  ছড়িয়ে পড়েছিল যে, গাসসানের শাসনকর্তা আমাদের উপর আক্রমণ চালাবার উদ্দেশ্যে তাদের ঘোড়াগুলোকে প্রস্ত্তত করছে। আমার প্রতিবেশী আনছার তার পালার দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খিদমতে থেকে রাতে ফিরে এসে আমার দরজায় করাঘাত করল এবং জিজ্ঞেস করল, আমি ঘরে আছি কি-না? আমি শংকিত অবস্থায় বেরিয়ে আসলাম।

সে বলল, আজ এক বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে। আমি বললাম, সেটা কী? গাসসানীরা কি এসে গেছে? সে বলল, না তার চেয়েও বড় ঘটনা এবং তা ভয়ংকর। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর সহধর্মিনীগণকে তালাক দিয়েছেন। আমি বললাম, হাফছাহ তো ধ্বংস হয়ে গেল, ব্যর্থ হ’ল। আমি আগেই ধারণা করেছিলাম, খুব শিগগিরই এ রকম কিছু ঘটবে। এরপর আমি পোশাক পরলাম এবং ফজরের ছালাত নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে আদায় করলাম।

নবী করীম (ছাঃ) উপরের কামরায় (মাশরুবা) একাকী আরোহন করলেন, আমি তখন হাফছার কাছে গেলাম এবং তাকে কাঁদতে দেখলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছ কেন? আমি কি তোমাকে এ ব্যাপারে আগেই সতর্ক করে দেইনি? নবী করীম (ছাঃ) কি তোমাদের সকলকে তালাক দিয়েছেন? সে বলল, আমি জানি না।

তিনি ওখানে উপরের কামরায় একাকী রয়েছেন। আমি সেখান থেকেই বেরিয়ে মিম্বরের কাছে বসলাম। সেখানে কিছু সংখ্যক লোক বসা ছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকেই  কাঁদছিল। আমি তাদের কাছে কিছুক্ষণ বসলাম, কিন্তু আমার প্রাণ এ অবস্থা সহ্য করতে পারছিল না। সুতরাং যে উপরের কক্ষে নবী করীম (ছাঃ) অবস্থান করছিলেন আমি সেই উপরের কক্ষে গেলাম এবং তাঁর হাবশী কালো খাদেমকে বললাম, তুমি কি ওমরের জন্য নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে যাবার অনুমতি এনে দেবে?

খাদেমটি গেল এবং নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে কথা বলল। ফিরে এসে উত্তর করল, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে আপনার কথা বলেছি, কিন্তু তিনি নিরুত্তর আছেন। তখন আমি ফিরে এলাম এবং যেখানে লোকজন বসা ছিল সেখানে বসলাম। কিন্তু এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। তাই আবার এসে খাদেমকে বললাম, তুমি কি ওমরের জন্য অনুমতি এনে দিবে? সে গেল এবং ফিরে এসে বলল, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে আপনার কথা বলেছি, কিন্তু তিনি নিরুত্তর ছিলেন।

তখন আমি আবার ফিরে এসে মিম্বরের কাছে ঐ লোকজনের সঙ্গে বসলাম। কিন্তু এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। পুনরায় আমি খাদেমের কাছে গেলাম এবং বললাম, তুমি কি ওমরের জন্য অনুমতি এনে দেবে? সে গেল এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল, আমি আপনার কথা উল্লেখ করলাম, কিন্তু তিনি নিরুত্তর আছেন।

যখন আমি ফিরে যাবার উদ্যোগ নিয়েছি, তখন খাদেমটি আমাকে ডেকে বলল, নবী করীম (ছাঃ) আপনাকে অনুমতি দিয়েছেন। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট প্রবেশ করে দেখলাম, তিনি খেজুরের চাটাইয়ের উপর চাদর বিহীন অবস্থায় খেজুরের পাতা ভর্তি একটি বালিশে ভর দিয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর শরীরে চাটাইয়ের চিহ্ন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

আমি তাঁকে সালাম করলাম এবং দাঁড়ানো অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি কি আপনার স্ত্রীগণকে তালাক দিয়েছেন? তিনি আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, না। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি যদি শোনেন তাহ’লে বলি, আমরা কুরাইশগণ, মহিলাদের উপর আমাদের প্রতিপত্তি খাটাতাম, কিন্তু আমরা মদীনায় এসে দেখলাম, এখানকার পুরুষদের উপর নারীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিদ্যমান। এ কথা শুনে নবী করীম (ছাঃ) মুচকি হাসলেন।

তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! যদি আপনি আমার কথার দিকে একটু নযর দেন। আমি হাফছার কাছে গেলাম এবং আমি তাকে বললাম, তোমার সতীনের রূপবতী হওয়া ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রিয় পাত্রী হওয়া তোমাকে যেন ধোঁকায় না ফেলে। এর দ্বারা আয়েশাহ (রাঃ)-এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

নবী করীম (ছাঃ) আবার মুচকি হাসলেন। আমি তাঁকে হাসতে দেখে বসে পড়লাম। এরপর আমি তাঁর ঘরের চার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। আল্লাহর কসম! কেবল তিনটি চামড়া ব্যতীত তাঁর ঘরে উল্লেখ করার মত কিছুই দেখতে পেলাম না।

তারপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! দো‘আ করুন, আল্লাহ তা‘আলা যাতে আপনার উম্মতদের সচ্ছলতা দান করেন। কেননা পারসিক ও রোমানদের প্রাচুর্য দান করা হয়েছে এবং তাদের দুনিয়ার শান্তি প্রচুর পরিমাণে দান করা হয়েছে, অথচ তারা আল্লাহর ইবাদত করে না।

একথা শুনে হেলান দেয়া অবস্থা থেকে নবী করীম (ছাঃ) সোজা হয়ে বসে বললেন, হে খাত্ত্বাবের পুত্র! তুমি কি এখনো এ ধারণা পোষণ করছ? ওরা ঐ লোক, যারা উত্তম কাজের প্রতিদান এ দুনিয়ায় পাচ্ছে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার ক্ষমার জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করুন।

হাফছাহ (রাঃ) কর্তৃক আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে কথা ফাঁস করে দেয়ার কারণে নবী করীম (ছাঃ) ঊনত্রিশ দিন তাঁর স্ত্রীগণ থেকে আলাদা থাকেন। নবী করীম (ছাঃ) বলেছিলেন, আমি এক মাসের মধ্যে তাদের কাছে যাব না তাদের প্রতি রাগের কারণে। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে মৃদু ভৎর্সনা করেন।

সুতরাং যখন ঊনত্রিশ দিন হয়ে গেল, নবী করীম (ছাঃ) সর্বপ্রথম আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে গেলেন এবং তাঁকে দিয়েই শুরু করলেন। আয়েশা (রাঃ) তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি কসম করেছেন যে, এক মাসের মধ্যে আমাদের কাছে আসবেন না; কিন্তু এখন তো ঊনত্রিশ দিনেই এসে গেলেন।

আমি প্রতিটি দিন এক এক করে হিসাব করে রেখেছি। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ঊনত্রিশ দিনেও মাস হয়। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, এ মাস ২৯ দিনের। আয়েশা (রাঃ) আরও বলেন, ঐ সময় আল্লাহ তা‘আলা এখতিয়ারের আয়াত অবতীর্ণ করেন, ‘যাতে নবী করীম (ছাঃ)-এর বিবিগণকে দুনিয়া বা আখিরাত এ দু’টোর যে কোন একটিকে বেছে নেয়ার জন্য বলা হয়েছে’ (আহযাব ২৮) এবং তিনি তাঁর স্ত্রীগণের মধ্যে আমাকে দিয়েই শুরু করেন এবং আমি তাঁকেই গ্রহণ করি। এরপর তিনি অন্য স্ত্রীগণের অভিমত চাইলেন। সকলেই তাই বলল, যা আয়েশা (রাঃ) বলেছিলেন (বুখারী হা/৪১৯১ ‘বিবাহ’ অধ্যায়)

রাসূলের স্ত্রীগণের দাবীর প্রেক্ষিতে তিনি তাদের নিকটে এক মাস না যাওয়ার কথা বলেন। মাস পূর্ণ হ’লে তিনি তাদের নিকটে যান। এদ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, স্ত্রীদের দাবী সঙ্গত না হ’লে বা তাদের শাসনের উদ্দেশ্যে তাদের থেকে পৃথক থাকা যায়। আল্লাহ আমাদেরকে এ হাদীছ থেকে শিক্ষা গ্রহণের তাওফীক দিন-আমীন!


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *