মদীনার পথে হিজরতের ঘটনা


রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কার কুরাইশদের অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে সেখান থেকে অন্যত্র হিজরতের জন্য আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন। অবশেষে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ আসলে তিনি আবূবকর (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে মদীনার পথে রওয়ানা হন। পিছনে শত্রু, সামনে বন্ধুর পথ।

এমতাবস্থায় আল্লাহর উপর সুদৃঢ় আস্থা ও নিশ্চিন্ত ভরসা রেখে সম্মুখে অগ্রসর হন। অবশেষে পৌঁছে যান মনযিলে মাকছূদে। এদিকে রাসূলের আগমন বার্তা শুনে এতদিন যারা ছিল অপেক্ষমান, তাদের প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হয়। মদীনায় বয়ে যায় আনন্দের বান। মদীনার পথে রাসূল (ছাঃ)-এর বিপদসংকুল দীর্ঘ সফরের বর্ণনা সম্পর্কে এ হাদীছ।-

নবীপত্নী আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার মাতা-পিতাকে কখনো ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন পালন করতে দেখিনি এবং এমন কোন দিন কাটেনি যেদিন সকালে কিংবা সন্ধ্যায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের বাড়িতে আসেননি। যখন মুসলমানগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়লেন, তখন আবূবকর (রাঃ) হিজরত করে আবিসিনিয়ায় যাওয়ার জন্য বের হ’লেন। শেষে ‘বারকুল গিমাদ’ পৌঁছলে ইবনু দাগিনার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। সে ছিল তার গোত্রের নেতা। সে বলল, হে আবূবকর! কোথায় যাচ্ছেন?

উত্তরে আবূবকর (রাঃ) বললেন, আমার স্ব-জাতি আমাকে বের করে দিয়েছে। তাই আমি মনে করছি, পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াব এবং আমার প্রতিপালকের ইবাদত করব। ইবনু দাগিনা বলল, হে আবূবকর! আপনার মত ব্যক্তি (দেশ থেকে) বের হ’তে পারেন না এবং আপনাকে বের করেও দেয়া যেতে পারে না। আপনি তো নিঃস্বদের জন্য উপার্জন করে দেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, অক্ষমদের বোঝা নিজে বহন করেন, মেহমানদের আপ্যায়ন করে থাকেন এবং সত্য পথের পথিকদের বিপদাপদে সাহায্য করেন।

সুতরাং আমি আপনাকে আশ্রয় দিচ্ছি, আপনাকে যাবতীয় সহযোগিতার ওয়াদা করছি। আপনি ফিরে যান এবং নিজ শহরে আপনার রবের ইবাদত করুন। আবূবকর (রাঃ) ফিরে আসলেন। তাঁর সঙ্গে ইবনু দাগিনাও আসল। ইবনু দাগিনা বিকাল বেলা কুরাইশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে গেল এবং তাদেরকে বলল, আবূবকরের মত লোক দেশ থেকে বের হ’তে পারে না এবং তাকে বের করেও দেয়া যায় না।

আপনারা কি এমন ব্যক্তিকে বের করবেন, যিনি নিঃস্বদের জন্য উপার্জন করেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, অক্ষমের বোঝা নিজে বহন করেন, মেহমানদের আপ্যায়ন করেন এবং ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে বিপদ আসলে সাহায্য করেন। ইবনু দাগিনার আশ্রয়দান কুরাইশরা মেনে নিল এবং তারা ইবনু দাগিনাকে বলল, তুমি আবূবকরকে বলে দাও, তিনি যেন তাঁর রবের ইবাদত তাঁর ঘরে করেন।

ছালাত সেখানেই আদায় করেন, ইচ্ছা মাফিক কুরআন তিলাওয়াত করেন। কিন্তু এর দ্বারা আমাদের যেন কষ্ট না দেন। আর এসব ব্যাপার যেন প্রকাশ্যে না করেন। কেননা আমরা আমাদের মেয়েদের ও ছেলেদের ফিতনায় পড়ে যাওয়ার ভয় করি। ইবনু দাগিনা এসব কথা আবূবকর (রাঃ)-কে বলে দিলেন। সে মতে কিছুকাল আবূবকর (রাঃ) নিজের ঘরে তাঁর রবের ইবাদত করতে লাগলেন।

ছালাত প্রকাশ্যে আদায় করতেন না এবং ঘরেই কুরআন তিলাওয়াত করতেন। এরপর আবূবকরের মনে খেয়াল জাগল। তাই তিনি তাঁর ঘরের পার্শ্বেই একটি মসজিদ তৈরী করে নিলেন। এতে তিনি ছালাত আদায় করতে ও কুরআন পড়তে লাগলেন। এতে তাঁর কাছে মুশরিকা মহিলা ও যুবকরা ভীড় জমাতে লাগল। তারা আবূ বকর (রাঃ)-এর একাজে বিস্ময়বোধ করত এবং তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকত।

আবূবকর (রাঃ) ছিলেন অধিক ক্রন্দনকারী ব্যক্তি, তিনি যখন কুরআন পড়তেন তখন তাঁর অশ্রু সামলিয়ে রাখতে পারতেন না। এ ব্যাপারটি মুশরিকদের নেতৃস্থানীয় কুরাইশদের ভীত করে তুলল এবং তারা ইবনু দাগিনাকে ডেকে পাঠাল। সে আসলে তারা তাকে বলল, তোমার আশ্রয় প্রদানের কারণে আমরাও আবূবকরকে আশ্রয় দিয়েছিলাম এই শর্তে যে, তিনি তাঁর রবের ইবাদত তাঁর ঘরে করবেন।

কিন্তু সে শর্ত তিনি ভঙ্গ করেছেন এবং নিজ গৃহের পাশে একটি মসজিদ তৈরী করে প্রকাশ্যে ছালাত ও তিলাওয়াত শুরু করেছেন। আমাদের ভয় হচ্ছে,  আমাদের মহিলা ও  সন্তানরা ফিতনায় পড়ে যাবে। কাজেই তুমি তাঁকে নিষেধ করে দাও। তিনি তাঁর রবের ইবাদত তাঁর গৃহের ভিতর সীমাবদ্ধ রাখতে চাইলে, তিনি তা করতে পারেন।

আর যদি তিনি তা অমান্য করে প্রকাশ্যে তা করতে চান, তবে তাঁকে তোমার আশ্রয় প্রদান ও দায়-দায়িত্ব ফিরিয়ে দিতে বল। আমরা তোমার আশ্রয় দানের ব্যাপারে বিশ্বাসঘাতকতা করা অত্যন্ত অপসন্দ করি। আবার আবূবকরকেও এভাবে প্রকাশ্যে ইবাদত করার জন্য ছেড়ে দিতে পারি না।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, ইবনু দাগিনা এসে আবূ বকর (রাঃ)-কে বলল, আপনি অবশ্যই জানেন যে, কী শর্তে আমি আপনার জন্য ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলাম। আপনি হয় তাতে সীমিত থাকবেন, অন্যথা আমার যিম্মাদারী আমাকে ফেরৎ দিবেন। আমি একথা মোটেই পসন্দ করি না যে, আমার সাথে চুক্তিবদ্ধ এবং আমার আশ্রয়প্রাপ্ত ব্যক্তির প্রতি আমার বিশ্বাসঘাতকতার অপবাদ আরববাসীর নিকট প্রকাশিত হোক।

আবূবকর (রাঃ) তাকে বললেন, আমি তোমার আশ্রয় তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। আমি আমার আল্লাহর আশ্রয়ের উপর সন্তুষ্ট আছি। এ সময় নবী করীম (ছাঃ) মক্কায় ছিলেন। নবী করীম (ছাঃ) মুসলমানদের বললেন, আমাকে তোমাদের হিজরতের স্থান (স্বপ্নে) দেখানো হয়েছে। সে স্থানে খেজুর বাগান রয়েছে এবং তা দু’টি পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত। এরপর যাঁরা হিজরত করতে চাইলেন, তাঁরা মদীনার দিকে হিজরত করলেন।

আর যাঁরা হিজরত করে আবিসিনিয়ায় চলে গিয়েছিলেন, তাঁদেরও অধিকাংশ সেখান হ’তে ফিরে মদীনায় চলে আসলেন। আবূবকর (রাঃ)ও মদীনায় যাওয়ার প্রস্ত্ততি নিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁকে বললেন, তুমি অপেক্ষা কর। আশা করছি আমাকেও অনুমতি দেয়া হবে। আবূবকর (রাঃ) বললেন, আমার পিতা আপনার জন্য কুরবান হোক! আপনিও হিজরতের আশা করছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন আবূবকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাহচর্য পাওয়ার জন্য নিজেকে হিজরত হ’তে বিরত রাখলেন এবং তাঁর নিকট যে দু’টি উট ছিল এ দু’টিকে চার মাস পর্যন্ত বাবলা গাছের পাতা খাওয়াতে থাকেন।

ইবনু শিহাব উরওয়াহ (রাঃ) সূত্রে আয়েশাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, ইতিমধ্যে একদিন আমরা ঠিক দুপুর বেলায় আবূবকর (রাঃ)-এর ঘরে উপবিষ্ট ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে আবূবকরকে খবর দিল যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাথা আবৃত অবস্থায় আসছেন। সেটা এমন সময় ছিল যে, এ সময় তিনি পূর্বে কখনো আমাদের এখানে আসেননি।

আবূবকর (রাঃ) তাঁর আসার কথা শুনে বললেন, আমার মাতাপিতা তাঁর প্রতি কুরবান হোক। আল্লাহর কসম! তিনি এ সময় নিশ্চয়ই কোন গুরুত্বপূর্ণ কারণেই আসছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পৌঁছে অনুমতি চাইলেন। তাঁকে অনুমতি দেয়া হ’ল। ঘরে প্রবেশ করে নবী করীম (ছাঃ) আবূবকরকে বললেন, এখানে অন্য যারা আছে তাদের বের করে দাও। আবূবকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার পিতামাতা আপনার প্রতি কুরবান হোক! এখানে তো আপনারই পরিবার।

তখন তিনি বললেন, আমাকেও হিজরতের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আবূ বকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান হোক! আমি আপনার সফরসঙ্গী হ’তে ইচ্ছুক। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ঠিক আছে। আবূবকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান হোক! আমার এ দু’টি উট হ’তে আপনি যে কোন একটি নিন।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তবে মূল্যের বিনিময়ে। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমরা তাঁদের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা অতি দ্রুত সম্পন্ন করলাম এবং একটি থলের মধ্যে তাঁদের জন্য খাদ্যসামগ্রী গুছিয়ে দিলাম। আমার বোন আসমা বিনতে আবূবকর (রাঃ) তার কোমরবন্ধের কিছু অংশ কেটে সে থলের মুখ বেঁধে দিলেন। এ কারণেই তাঁকে ‘জাতুন নেতাক’ (কোমরবন্ধ ওয়ালী) বলা হ’ত।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবূবকর (রাঃ) ছাওর পর্বতের একটি গুহায় আশ্রয় নিলেন। তাঁরা সেখানে তিনটি রাত অবস্থান করলেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আবূবকর (রাঃ) তাঁদের পাশেই রাত্রি যাপন করতেন। তিনি ছিলেন একজন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন তরুণ। তিনি শেষ রাত্রে ওখান হ’তে বেরিয়ে মক্কায় রাত্রি যাপনকারী কুরাইশদের সঙ্গে মিলিত হ’তেন এবং তাঁদের দু’জনের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র করা হ’ত তা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন ও স্মরণ রাখতেন।

যখন আঁধার ঘনিয়ে আসত তখন তিনি সংবাদ নিয়ে তাঁদের উভয়ের কাছে যেতেন। আবূবকর (রাঃ)-এর গোলাম আমির ইবনু ফুহাইরাহ তাঁদের কাছেই দুধালো বকরীর পাল চরিয়ে বেড়াত। রাতের কিছু সময় চলে গেলে পরে সে বকরীর পাল নিয়ে তাঁদের নিকটে যেত এবং তাঁরা দু’জন দুধ পান করে আরামে রাত্রিযাপন করতেন। তাঁরা বকরীর দুধ দোহন করে সাথে সাথেই পান করতেন। তারপর শেষ রাত্রে আমির ইবনু ফুহাইরাহ বকরীগুলি হাঁকিয়ে নিয়ে যেত। এ তিন রাতের প্রতি রাতে সে এমনই করল।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবূবকর (রাঃ) বনী আবদ ইবনু আদি গোত্রের এক ব্যক্তিকে মজুরীর বিনিময়ে ‘খিররীত’ (পথ প্রদর্শক) নিযুক্ত করেছিলেন। দক্ষ পথপ্রদর্শককে ‘খিররীত’ বলা হয়। আছ ইবনু ওয়ায়েল আস-সাহমী গোত্রের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল। সে ছিল কাফির কুরাইশদের ধর্মাবলম্বী।

তাঁরা উভয়ে তাকে বিশ্বস্ত মনে করে তাঁদের উট দু’টি তার হাতে দিয়ে দিলেন এবং তৃতীয় রাত্রের পরে সকালে উট দু’টি ছাওর গুহার নিকট নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করলেন। আর সে যথাসময়ে তা পৌঁছে দিল। আর আমির ইবনু ফুহাইরাহ ও পথপ্রদর্শক তাঁদের উভয়ের সঙ্গে চলল। প্রদর্শক তাঁদের নিয়ে উপকূলের পথ ধরে চলতে লাগল।

ইবনু শিহাব বলেন, আব্দুর রহমান ইবনু মালিক মুদলেজী আমাকে বলেছেন, তিনি সুরাক্বাহ ইবনু মালিকের ভ্রাতুষ্পুত্র। তার পিতা তাকে বলেছেন, তিনি সুরাক্বাহ ইবনু জু‘শুমকে বলতে শুনেছেন যে, আমাদের নিকট কুরাইশী কাফিরদের দূত আসল এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবূবকর (রাঃ) এ দু’জনের যে কোন একজনকে যে হত্যা করবে অথবা বন্দী করতে পারবে তাকে পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিল।

আমি আমার কওম বনী মুদলিজের এক মজলিসে উপবিষ্ট ছিলাম। তখন তাদের নিকট হ’তে এক ব্যক্তি এসে আমাদের নিকটে দাঁড়াল। আমরা বসাই ছিলাম। সে বলল, হে সুরাক্বাহ! আমি এই মাত্র উপকূলের পথে কয়েকজন মানুষকে যেতে দেখলাম। আমার ধারণা, এরা মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর সহযাত্রীরা হবেন। সুরাক্বাহ বলেন, আমি বুঝতে পারলাম যে এঁরা তাঁরাই হবেন।

কিন্তু তাকে বললাম, এঁরা তাঁরা নয়, বরং তুমি অমুক অমুককে দেখছ। এরা এই মাত্র আমাদের সম্মুখ দিয়ে চলে গেল। তারপর আমি কিছুক্ষণ মজলিসে অবস্থান করে চলে এলাম এবং আমার দাসীকে আদেশ করলাম, তুমি আমার ঘোড়াটি বের করে নিয়ে যাও এবং অমুক টিলার আড়ালে ঘোড়াটি ধরে দাঁড়িয়ে থাক। আমি আমার বর্শা হাতে নিলাম এবং বাড়ির পিছন দিক দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

বর্শাটির এক প্রান্ত হাতে ধরে অপর প্রান্ত মাটি হেচড়ানো অবস্থায় আমি টেনে নিয়ে চলছিলাম ঐ অবস্থায় বর্শার মাটি হেচড়ানো অংশ দ্বারা মাটির উপর রেখাপাত করতে করতে আমার ঘোড়ার নিকট গিয়ে পৌঁছলাম এবং ঘোড়ায় আরোহণ করে তাকে খুব দ্রুত ছুটালাম। সে আমাকে নিয়ে ছুটে চলল। আমি প্রায় তাদের নিকট পৌঁছে গেলাম, এমন সময় আমার ঘোড়াটি হোঁচট খেয়ে আমাকে নিয়ে পড়ে গেল। আমিও তার পিঠ হ’তে ছিটকে পড়লাম।

তারপর আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং তুণের দিকে হাত বাড়ালাম। তা হ’তে তীরগুলি বের করলাম ও তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে ভাগ্য পরীক্ষা করে নিলাম যে, আমি তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবো কি-না? তখন তীরগুলি দুর্ভাগ্যবশতঃ এমনভাবে বেরিয়ে এল যে, ভাগ্য নির্ধারণের বেলায় এমন হওয়া পসন্দ করি না। আমি আবার ভাগ্য পরীক্ষার ফলাফল অমান্য করে অশ্বারোহণ করে সম্মুখ পানে এগুতে লাগলাম।

আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এত নিকটবর্তী হয়ে গেলাম যে তাঁর তিলাওয়াতের আওয়ায শুনতে পাচ্ছিলাম। তিনি ফিরে তাকাচ্ছিলেন না। কিন্তু আবূবকর (রাঃ) বারবার তাকিয়ে দেখছিলেন। এমন সময় হঠাৎ আমার ঘোড়ার সামনের পা দু’টি হাঁটু পর্যন্ত মাটিতে গেড়ে গেল এবং আমি তার উপর হ’তে পড়ে গেলাম। তখন ঘোড়াটিকে ধমক দিলাম, সে দাঁড়াতে ইচ্ছা করল, কিন্তু পা দু’টি বের করতে পারছিল না।

শেষে যখন ঘোড়াটি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল, তখন হঠাৎ তার সামনের পা দু’টি বের করতে পারছিল না। অবশেষে যখন ঘোড়াটি সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল, তখন তার সামনের পা দু’টি যেখানে গেড়ে ছিল সেখান হ’তে ধূঁয়ার মত ধূলি আকাশের দিকে উঠতে লাগল। তখন আমি তীর দিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করলাম। এবারও যা আমার অপসন্দনীয় তা-ই প্রকাশ পেল। তখন উচ্চৈঃস্বরে তাঁদের নিরাপত্তা চাইলাম।

এতে তাঁরা থেমে গেলেন এবং আমি আমার ঘোড়ায় আরোহণ করে এলাম। আমি যখন এমন অবস্থায় বার বার বাধাপ্রাপ্ত ও বিপদে পড়ছিলাম তখনই আমার অন্তরে এ বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছিল যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এ মিশনটি অচিরেই প্রভাব বিস্তার করবে। তখন আমি তাঁকে বললাম, আপনার কওম আপনাকে ধরে দিতে পারলে একশ’ উট পুরস্কার ঘোষণা করেছে।

মক্কার কাফিররা তাঁর সম্পর্কে যে ইচ্ছা করেছে তা তাঁকে জানালাম এবং আমি তাঁদের জন্য কিছু খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী পেশ করলাম। তাঁরা তা হ’তে কিছুই নিলেন না। আর আমার কাছে এ কথা ছাড়া কিছুই চাইলেন না- ‘আমাদের খবরটি গোপন রেখ’। এরপর আমি আমাকে একটি নিরাপত্তা লিপি লিখে দেয়ার জন্য তাঁকে অনুরোধ করলাম। তখন তিনি আমির ইবনু ফুহাইরাহকে আদেশ দিলেন। তিনি এক টুকরো চামড়ায় তা লিখে দিলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রওয়ানা দিলেন।

ইবনু শিহাব (রহঃ) বলেন, উরওয়াহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) আমাকে বলেছেন, পথিমধ্যে যুবায়েরের সাথে নবী করীম (ছাঃ)-এর সাক্ষাৎ হয়। তিনি মুসলমানদের একটি বণিক কাফেলার সাথে সিরিয়া হ’তে ফিরছিলেন। তখন যুবায়ের (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবূবকর (রাঃ)-কে সাদা রঙের পোশাক দান করলেন। এদিকে মদীনায় মুসলিমগণ শুনলেন যে, নবী করীম (ছাঃ) মক্কাহ হ’তে মদীনার পথে রওয়ানা হয়েছেন।

তাই তাঁরা প্রতিদিন সকালে মদীনার হাররা পর্যন্ত গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। দুপুরে রোদ প্রখর হ’লে তারা ঘরে ফিরে আসতেন। একদিন তারা পূর্বাপেক্ষা বেশী সময় প্রতীক্ষা করার পর নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেলেন। এমন সময় এক ইহুদী একটি টিলায় আরোহণ করে এদিক-ওদিক কি যেন দেখছিল।

তখন সে নবী করীম (ছাঃ) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকে সাদা পোশাক পরা অবস্থায় মরীচিকাময় মরুভূমির উপর দিয়ে আগমন করতে দেখতে পেল। ইহূদী তখন নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করে বলে উঠল, হে আরব সম্প্রদায়! এইতো সে ভাগ্যবান ব্যক্তি, যার জন্য তোমরা অপেক্ষা করছ। মুসলিমগণ তাড়াতাড়ি হাতিয়ার তুলে নিয়ে মদীনার হাররার উপকণ্ঠে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে মিলিত হ’লেন। তিনি সকলকে নিয়ে ডানদিকে গিয়ে বনু আমর ইবনু আউফ গোত্রে অবতরণ করলেন।

এদিনটি ছিল রবীউল আউয়াল মাসের সোমবার। আবূবকর (রাঃ) দাঁড়িয়ে লোকদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নীরব রইলেন। আনছারদের মধ্য হ’তে যাঁরা এ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে দেখেননি তাঁরা আবূবকর (রাঃ)-কে সালাম করতে লাগলেন। তারপর যখন রৌদ্রের উত্তাপ নবী করীম (ছাঃ)-এর উপর পড়তে লাগল এবং আবূবকর (রাঃ) অগ্রসর হয়ে তাঁর চাদর দিয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর উপর ছায়া করে দিলেন, তখন লোকেরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে চিনতে পারল।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বনু আমর ইবনু আউফ গোত্রে দশদিনের চেয়ে কিছু বেশী সময় কাটালেন এবং সে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন, যা তাক্বওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এতে ছালাত আদায় করেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর উটনীতে আরোহণ করে রওয়ানা হ’লেন। লোকেরাও তাঁর সঙ্গে চলতে লাগলেন।

মদীনার মসজিদে নববীর স্থানে পৌঁছে উটনীটি বসে পড়ল। সে সময় ঐ স্থানে কতিপয় মুসলিম ছালাত আদায় করতেন। এ জায়গাটি ছিল আস‘আদ ইবনু যুরারাহর আশ্রয়ে পালিত সাহল ও সুহায়েল নামক দু’জন ইয়াতীম বালকের খেজুর শুকাবার স্থান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিয়ে উটনীটি যখন এ স্থানে বসে পড়ল, তখন তিনি বললেন, ইনশাআল্লাহ এ স্থানটিই হবে আবাসস্থল।

তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেই বালক দু’টিকে ডেকে পাঠালেন এবং মসজিদ তৈরীর জন্য তাদের কাছে জায়গাটি মূল্যের বিনিময়ে বিক্রয়ের ব্যাপারে আলোচনা করলেন। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! বরং এটি আমরা আপনার জন্য বিনামূল্যে দিচ্ছি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের নিকট হ’তে বিনামূল্যে গ্রহণে অসম্মতি জানালেন এবং অবশেষে স্থানটি তাদের হ’তে ক্রয় করে নিলেন। তারপর সে স্থানে তিনি মসজিদ তৈরী করলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদ নির্মাণকালে ছাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে ইট বহন করছিলেন এবং ইট বহনের সময় তিনি আবৃত্তি করছিলেন,

هَذَا الْحِمَالُ لاَ حِمَالَ خَيْبَرْ * هَذَا أَبَرُّ رَبَّنَا وَأَطْهَرْ

‘এ বোঝা খায়বারের বোঝা বহন নয়।

হে আমাদের প্রভু! এর বোঝা অত্যন্ত পুণ্যময় ও অতি পবিত্র’।

তিনি আরো বলছিলেন,

اللَّهُمَّ إِنَّ الأَجْرَ أَجْرُ الآخِرَهْ * فَارْحَمِ الأَنْصَارَ وَالْمُهَاجِرَهْ

‘হে আল্লাহ! পরকালের প্রতিদানই প্রকৃত প্রতিদান।

সুতরাং আনছার ও মুহাজিরদের প্রতি অনুগ্রহ করুন’।

তিনি এক মুসলিম কবির কবিতা আবৃত্তি করেন, যার নাম আমাকে বলা হয়নি। ইবনু শিহাব (রহঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এছাড়া অপর কোন পূর্ণ কবিতা পাঠ করেছেন বলে, কোন কথা আমার কাছে পৌঁছেনি’ (বুখারী হা/৩৯০৫)

পরিশেষে বলব, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট’ (তালাক্ব ৩)। আল্লাহর উপর নির্ভরতাই রাসূলকে কুরাইশদের শক্ত বাধার বিপক্ষে বিজয়ী করেছিল; হিজরতকালে পিছন থেকে ধেয়ে আসা সশস্ত্র শত্রু সুরাক্বাহ বিন মালেকের হাত থেকে রক্ষা করে নিরাপদে মদীনায় পৌঁছে দিয়েছিল। আমাদেরকেও তেমনি আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল হ’তে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *