কুষ্ঠরোগী, টেকো ও অন্ধের গল্প


এ পৃথিবীতে আল্লাহ মানুষকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে থাকেন। কাউকে রোগ-শোক, দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন দিয়ে। আবার কাউকে সম্পদের প্রাচুর্য, বিলাস বহুল জীবন ও সুখ-সমৃদ্ধি দান করে। সেকারণ মানুষের উচিত বিপদাপদে আল্লাহ্র নিকটেই পরিত্রাণ প্রার্থনা করা এবং সুখে-শান্তিতেও মহান আল্লাহ্র শুকরিয়া জ্ঞাপন করা।

কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘যদি তোমরা আমার নে‘মতের কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তাহ’লে আমি অধিক পরিমাণে প্রদান করব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও তাহ’লে জেনে রেখ আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন’ (ইবরাহীম ৭)

সুতরাং মানুষকে পূর্বের অবস্থা স্মরণ রেখে আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে হবে। অন্যথা অকৃতজ্ঞ হওয়ার কারণে দুনিয়াতেই আল্লাহ শাস্তি দিতে পারেন। এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীছি প্রণিধানযোগ্য :

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ)-কে তিনি বলতে শুনেছেন যে, বনী ইসরাঈলের মাঝে তিনজন ব্যক্তি ছিল; কুষ্ঠরোগী, টেকো ও অন্ধ। মহান আল্লাহ তাদেরকে পরীক্ষা করতে চাইলেন এবং তাদের নিকট একজন ফেরেশতা পাঠালেন।

অতঃপর কুষ্ঠরোগীর কাছে এসে তিনি বললেন, তোমার সবচেয়ে পসন্দের জিনিস কোনটি? সে বলল, সুন্দর চামড়া এবং সেই রোগ থেকে আরোগ্য লাভ, লোকেরা যার কারণে আমাকে ঘৃণা করে। ফেরেশতা তার শরীর মুছে দিলেন। এতে তার রোগ দূর হ’ল এবং তাকে সুন্দর বর্ণ দান করা হ’ল। অতঃপর তিনি প্রশ্ন করলেন, তোমার নিকট কোন সম্পদ সবচেয়ে বেশী পসন্দনীয়? সে বলল, উট অথবা গরু (বর্ণনাকারীর সন্দেহ)।

তাকে তখন দশ মাসের গর্ভবতী একটি উটনী দেয়া হ’ল। ফেরেশতা বললেন, আল্লাহ এতে তোমায় বরকত দিন। তারপর তিনি টেকো ব্যক্তির কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, তোমার সবচেয়ে পসন্দের জিনিস কোনটি? সে বলল, সুন্দর চুল এবং এই টাক হ’তে মুক্তি, লোকেরা যার কারণে আমাকে ঘৃণা করে। তিনি তার মাথা মুছে দিলেন।

এতে তার টাক ভাল হয়ে গেল এবং তাকে সুন্দর চুল দান করা হ’ল। তিনি প্রশ্ন করলেন, কোন মাল তোমার নিকট অধিক প্রিয়? সে বলল, গরু। তখন তাকে একটি গর্ভবতী গাভী দেয়া হ’ল। তিনি বললেন, আল্লাহ এতে তোমাকে বরকত দিন। তারপর ফেরেশতা অন্ধ ব্যক্তির কাছে এসে প্রশ্ন করলেন, তোমার অধিক পসন্দের জিনিস কি?

সে বলল, আল্লাহ আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিন, আমি যাতে মানুষকে দেখতে পারি। ফেরেশতা তার চোখ স্পর্শ করলেন। এতে তার চোখের দৃষ্টি আল্লাহ ফিরিয়ে দিলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, কোন মাল তোমার নিকট অধিক প্রিয়? সে বলল, ছাগল। তাকে তখন এমন ছাগী দেয়া হ’ল, যা অধিক সংখ্যক বাচ্চা দেয়।

তারপর উট, গাভী ও ছাগলের বাচ্চা হ’ল এবং উট দিয়ে একটি ময়দান, গরু দিয়ে আরেকটি ময়দান এবং ছাগল দিয়ে অন্য একটি ময়দান ভরে গেল। তারপর ফেরেশতা কুষ্ঠরোগীর কাছে তাঁর প্রথম রূপ ধারণ করে এসে বললেন, আমি একজন মিসকীন। সফরে আমার সবকিছু নিঃশেষ হয়ে গেছে।

আজ আল্লাহ ব্যতীত কেউ নেই যার সাহায্যে আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছতে পারি, তারপর তোমার সহায়তায়। যে আল্লাহ তোমাকে সুন্দর বর্ণ, সুন্দর ত্বক ও সম্পদ দিয়েছেন, সে আল্লাহ্র নামে তোমার নিকট আমি একটা উট চাচ্ছি, যার সাহায্যে আমি গন্তব্যে পৌঁছতে পারি। সে বলল, (আমার উপর) অনেকের অধিকার রয়েছে।

তিনি বললেন, তোমাকে বোধহয় আমি চিনি। তুমি কুষ্ঠরোগী ছিলে না? লোকেরা তোমাকে কি ঘৃণা করত না? তুমি না নিঃস্ব ছিলে? আল্লাহ তোমাকে সম্পদ দিয়েছেন। সে বলল, এই সম্পদ তো আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পূর্বপুরুষ থেকে পেয়েছি। তিনি বললেন, তুমি যদি মিথ্যাবাদী হও তাহ’লে তোমাকে যেন আল্লাহ আগের মতো করে দেন।

এরপর তিনি টেকো ব্যক্তির কাছে তাঁর প্রথম রূপ ধারণ করে এসে অনুরূপ বললেন, প্রথম লোকটিকে যা বলেছিলেন এবং সে সেই উত্তরই দিল, যা পূর্বের লোকটি দিয়েছিল। ফেরেশতা একেও বললেন, তুমি যদি মিথ্যাবাদী হয়ে থাক তাহ’লে আল্লাহ যেন তোমাকে পুনরায় আগের মতো করে দেন।

এরপর ফেরেশতা অন্ধ ব্যক্তির কাছে তাঁর আগের রূপ ধারণ করে এসে বললেন, আমি একজন মিসকীন ও পথিক। আমার সবকিছু সফরে নিঃশেষ হয়ে গেছে। এখন গন্তব্যে পৌঁছতে আল্লাহ ব্যতীত আর কোন উপায় নেই, তারপর তোমার সহায়তায়। সেই আল্লাহ্র নামে তোমার কাছে একটি ছাগল সাহায্য চাচ্ছি, যিনি তোমাকে তোমার চোখ ফেরত দিয়েছেন।

লোকটি বলল, আমি অন্ধ ছিলাম। আমাকে আমার দৃষ্টিশক্তি আল্লাহ ফেরত দিয়েছেন। কাজেই তোমার যত ইচ্ছা মাল তুমি নিয়ে যাও, আর যা ইচ্ছা রেখে যাও। আল্লাহ্র শপথ! মহান আল্লাহ্র ওয়াস্তে আজ তুমি যা কিছু নিবে তাতে আমি তোমাকে বাঁধা  প্রদান করব না। ফেরেশতা বললেন, তোমার সম্পদ তোমার কাছেই রাখ।

তোমাদেরকে শুধুমাত্র পরীক্ষা করা হয়েছে। তোমার প্রতি আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট এবং তোমার অপর দু’জন সাথীর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন (বুখারী হা/৩৪৬৪; মুসলিম হা/২৯৬৪)

আল্লাহ যে মানুষকে পরীক্ষা করেন উপরোক্ত হাদীছ তার বাস্তব প্রমাণ। সুতরাং দুনিয়ার মোহমায়ায় ও এর প্রাচুর্যে আবিষ্ট হয়ে আল্লাহ্র নে‘মতকে ভুলে না গিয়ে, আল্লাহ্র নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করাই যথার্থ মুমিনের পরিচয়।


One response to “কুষ্ঠরোগী, টেকো ও অন্ধের গল্প”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *