আরবের মরুদুলাল শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন ও মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন। তাই আমরা প্রথমে আরবদেশ সম্পর্কে আলোকপাত করব।
আরবের অবস্থান স্থল:
মক্কাকে পৃথিবীর নাভিস্থল (وسط الأرض ) বলা হয়। কুরআনে একে ‘উম্মুল ক্বোরা’ বা ‘আদি জনপদ’ বলা হয়েছে (আন‘আম ৬/৯২; শূরা ৪২/৭)। তিনদিকে সাগর বেষ্টিত প্রায় ১৩ লক্ষ বর্গমাইল ব্যাপী আরব উপদ্বীপ কেবল পৃথিবীর মধ্যস্থলেই অবস্থিত নয়, বরং এটি তখন ছিল চতুর্দিকের সহজ যোগাযোগস্থল ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমি। বর্তমান ফ্রান্সের প্রায় দ্বিগুণ এই বিশাল ভূখন্ডটির অধিকাংশ এলাকা মরুময়। অথচ এই ধূসর মরুর নীচে রয়েছে আল্লাহর রহমতের ফল্গুধারা বিশ্বের মূল্যবান তরল সোনার সর্বোচ্চ রিজার্ভ। এর পশ্চিমে লোহিত সাগর, পূর্বে আরব উপসাগর, দক্ষিণে আরব সাগর (যা ভারত মহাসাগরের বিস্তৃত অংশ) এবং উত্তরে সিরিয়া ও ইরাকের ভূখন্ড। পানিপথ ও স্থলপথে আরব উপদ্বীপ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ তিনটি মহাদেশের সাথে যুক্ত। আদি পিতা আদম, নূহ, ইদ্রীস, ছালেহ, ইবরাহীম, লূত্ব, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়াকূব, শু‘আয়েব, মূসা, দাঊদ, সুলায়মান, ইলিয়াস, যাকারিয়া, ইয়াহ্ইয়া, ঈসা (আলাইহিমুস সালাম) এবং সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) সহ সকল নবী ও রাসূলের আবির্ভাব ও কর্মস্থল ছিল এই পবিত্র ভূখন্ড।
এর প্রথম কারণ ছিল অনুর্বর এলাকা হওয়ার কারণে পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার সঙ্গে আরবদের নিয়মিত বাণিজ্যিক যোগাযোগ থাকায় এখানে নবুঅতের দাওয়াত দিলে তা সাথে সাথে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ত।
দ্বিতীয় কারণ: এই ভূখন্ডে ছিল দুইটি পবিত্র স্থানের অবস্থিতি। প্রথমটি এবং সর্বশ্রেষ্ঠটি ছিল মক্কায় বায়তুল্লাহ বা কা‘বা শরীফ। যা হযরত আদম (আঃ) কর্তৃক প্রথম নির্মিত হয়। অতঃপর হযরত ইবরাহীম ও তৎপুত্র ইসমাঈলের হাতে পুনর্নির্মিত হয়। দ্বিতীয়টি ছিল বায়তুল মুক্বাদ্দাস, যা কা‘বা গৃহের চল্লিশ বছর পর আদম পুত্রগণের কারু হাতে প্রথম নির্মিত হয়। অতঃপর ইবরাহীমের পৌত্র ইয়াকূব বিন ইসহাক (আঃ) কর্তৃক নির্মিত হয়। অতঃপর দাউদ ও সুলায়মান (আঃ) কর্তৃক পুনর্নিমিত হয়। ইবরাহীম পুত্র ইসমাঈল-এর বংশধরগণ মক্কা এলাকা আবাদ করেন এবং বংশ পরম্পরায় তাঁরাই বায়তুল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ, হাজী ছাহেবদের জান-মালের হেফাযত, তাদের পানি সরবরাহ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে ইবরাহীমের কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর বংশধরগণ বায়তুল মুক্বাদ্দাস তথা আজকের ফিলিস্তীন এলাকায় বসবাস করেন। ইসহাকপুত্র ইয়াকূব (আঃ)-এর অপর নাম ছিল ‘ইসরাঈল’। সেকারণ তাঁর বংশধর ‘বনু ইসরাঈল’ নামে খ্যাত। এভাবে আরব উপদ্বীপের দুই প্রধান এলাকা সহ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র ইবরাহীমের বংশধর বনু ইসমাঈল ও বনু ইসরাঈল কর্তৃক তাওহীদের দাওয়াত প্রসার লাভ করে। সাথে সাথে তাদের সম্মান ও প্রতিপত্তি সর্বত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللّهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوْحاً وَآلَ إِبْرَاهِيْمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِيْنَ- ذُرِّيَّةً بَعْضُهَا مِنْ بَعْضٍ وَاللّهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ নির্বাচন করেছেন আদম ও নূহকে এবং ইবরাহীম পরিবার ও ইমরান পরিবারকে জগদ্বাসীর মধ্য হ’তে’। ‘তারা একে অপরের সন্তান। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আলে ইমরান ৩/৩৩-৩৪)।
রাজনৈতিক অবস্থা:
এই সময় আরবের দক্ষিণাংশে ছিল হাবশার সাম্রাজ্য, পূর্বাংশে ছিল পারসিক সাম্রাজ্য এবং উত্তরাংশের ভূখন্ড সমূহ ছিল রোমক সাম্রাজ্যের করতলগত। সম্রাট শাসিত এইসব অঞ্চলের অধিবাসীগণ সবাই ছিল ধর্মের দিক দিয়ে খৃষ্টান। যদিও প্রকৃত ধর্ম বলতে সেখানে কিছুই ছিল না। মক্কা ও ইয়াছবির (মদীনা) সহ আরবের বাকী ভূখন্ডের লোকেরা স্বাধীন ছিল। তাদের কোন কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ছিল না। তবে তারা গোত্রপতি শাসিত ছিল। তাদের মধ্যে দুঃসাহসিকতা ও বেপরোয়া ভাবটা ছিল তূলনামূলকভাবে বেশী। তাদের মধ্যে যেমন অসংখ্য দোষ-ত্রুটি ছিল, তেমনি ছিল অনন্য সাধারণ গুণাবলী, যা অন্যত্র কদাচিৎ পাওয়া যেত। তাদের সৎসাহস, আমানতদারী, সত্যবাদিতা, কাব্য প্রতিভা, স্মৃতিশক্তি, অতিথিপরায়ণতা ছিল কিংবদন্তীতুল্য। বছরে চার মাস তাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। মক্কার লোকেরা ইহুদী বা খৃষ্টান ছিল না। তারা নিজেদেরকে ইবরাহীম (আঃ)-এর একান্ত অনুসারী হিসাবে ‘হানীফ’ (একনিষ্ঠ একত্ববাদী) বলত। মক্কা ছিল সমগ্র আরব ভূখন্ডের কেন্দ্রবিন্দু এবং সম্মান ও মর্যাদায় শীর্ষস্থানীয়। সেকারণ খৃষ্টান রাজারা এর উপরে দখল কায়েম করার জন্য বারবার চেষ্টা করত। এক সময় ইয়ামনের নরপতি আবরাহা নিজ রাজধানীতে স্বর্ণ-রৌপ্য দিয়ে কা‘বা গৃহের আদলে একটি সুন্দর গৃহ নির্মাণ করেন এবং সবাইকে সেখানে হজ্জ করার নির্দেশ জারি করেন। কিন্তু জনগণ তাতে সাড়া দেয়নি। বরং কে একজন গিয়ে তার ঐ নকল কা‘বা গৃহে (?) পায়খানা করে আসে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সে প্রায় ৬০,০০০ সৈন্য ও হস্তীবাহিনী নিয়ে মক্কায় অভিযান করে কা‘বা গৃহকে ধ্বংস করার জন্য। অবশেষে আল্লাহর গযবে তিনি নিজে তার সৈন্যসামন্ত সহ ধ্বংস হয়ে যান। এতে মক্কার সম্মান ও মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায় এবং এ ঘটনা বণিকদের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জন্মের মাত্র ৫০ বা ৫৫ দিন পূর্বে এই অলৌকিক ঘটনা ঘটে। বস্ত্ততঃ এটা ছিল শেষনবীর আগমনের আগাম শুভ সংকেত।
সমগ্র আরব ভূখন্ডে মক্কার ব্যবসায়ীদের মর্যাদা ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। তারা শীতকালে ইয়ামনে ও গ্রীষ্মকালে শাম বা সিরিয়ায় ব্যবসার জন্য যাতায়াত করত। কিন্তু এই দীর্ঘ সফরে কখনো তাদের কাফেলা লুট হ’ত না। হারম শরীফের মর্যাদার কারণে তাদের মর্যাদা আপামর জনগণের মধ্যে এমনভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল যে, চোর-ডাকাতেরাও তাদেরকে সমীহ করত। এটাই যেখানে বাস্তবতা, সেখানে তাদেরকে ‘জাহেলী আরব’ কেন বলা হয়? এর কারণ সম্ভবতঃ এটাই ছিল যে, তারা ইবরাহীম (আঃ)-এর অনুসারী হবার দাবীদার হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর বিধান সমূহকে অগ্রাহ্য করেছিল এবং খোদ আল্লাহর ঘরেই মূর্তি পূজা শুরু করেছিল। তারা শেষনবীকে চিনতে পেরেও তাঁকে অস্বীকার করেছিল। নিঃসন্দেহে এটা ছিল সবচেয়ে বড় জাহেলিয়াত ও সবচেয়ে বড় মূর্খতা। আর একারণেই তো ‘জ্ঞানের পিতা’ আবুল হেকাম-কে ‘মূর্খতার পিতা’ আবু জাহল লকব দেওয়া হ’ল। এক্ষণে আমরা মক্কায় শিরক প্রসারের ইতিবৃত্ত সংক্ষেপে বর্ণনা করব।-
মক্কার ধর্মীয় অবস্থা : শিরকের প্রচলন
মক্কার লোকেরা মূলতঃ হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর ছিল এবং তারা জন্মগতভাবেই তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতে বিশ্বাসী ছিল। তারা কা‘বা গৃহকে যথার্থভাবেই আল্লাহর গৃহ বা বায়তুল্লাহ বলে বিশ্বাস করত এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করত। তারা এখানে নিয়মিতভাবে ত্বাওয়াফ, সাঈ ও হজ্জ করত এবং বহিরাগত হাজীদের নিরাপত্তা ও পানি সরবরাহের দায়িত্ব পালন করত। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ কোন নবী না আসায় শয়তানী প্ররোচনায় তাদের সমাজনেতা ও ধনিক শ্রেণীর অনেকে পথভ্রষ্ট হয়ে যায় এবং এক সময় তাদের মাধ্যমেই মূর্তি পূজার শিরকের সূচনা হয়, যেভাবে ইতিপূর্বে নূহের সমাজে হয়েছিল।
(১) কুরায়েশ বংশের বনু খোযা‘আহ গোত্রের সরদার আমর বিন লুহাই (عمروبن لحى ) অত্যন্ত ধার্মিক, দানশীল ও দরবেশ স্বভাবের লোক ছিলেন। লোকেরা তাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করত এবং তার প্রতি অন্ধভক্তি পোষণ করত। তাকে আরবের শ্রেষ্ঠ আলেম ও অলি-আউলিয়াদের মধ্যে গণ্য করা হ’ত। অতএব শয়তান তাকেই বেছে নিল তার কার্যসিদ্ধির জন্য। একবার তিনি শামে গিয়ে দেখেন যে, সেখানকার লোকেরা জমকালো আয়োজনের সাথে ‘হোবল’ (هبل ) নামক মূর্তির পূজা করে। এর অসীলায় তারা বৃষ্টি প্রার্থনা করে। আমর ভাবলো অসংখ্য নবী-রাসূলের জন্ম ও কর্মভূমি এই শামের ধার্মিক লোকেরা যখন হোবল মূর্তির অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করে, তখন আমরাও এটা করলে উপকৃত হব। ফলে বহু মূল্যের বিনিময়ে আমর একটা হোবল মূর্তি খরিদ করে নিয়ে গেল এবং মক্কার নেতাদের রাযী করিয়ে কা‘বাগৃহে স্থাপন করল। কথিত আছে যে, একটা জিন আমরের অনুগত ছিল। (২) সেই-ই তাকে খবর দেয় যে, নূহ (আঃ)-এর সময়কার বিখ্যাত অদ, সুওয়া‘ ইয়াগূছ, ইয়াঊক্ব, নাসর (নূহ ৭১/২৩) প্রতিমাগুলি জেদ্দার অমুক স্থানে মাটিতে প্রোথিত আছে। আমর সেখানে গিয়ে সেগুলো উঠিয়ে এনে তেহামায় রেখে দিল। অতঃপর হজ্জ-এর মওসুমে সেগুলিকে বিভিন্ন গোত্রের হাতে সোপর্দ করে দিল। এসব মূর্তি ছাড়াও আরবের প্রাচীনতম মূর্তি ছিল লোহিত সাগরের নিকটবর্তী ‘মুসাল্লাল’ নামক স্থানের ‘মানাত’ (مناة) , ত্বায়েফের ‘লাত’ (لات) এবং নাখলা উপত্যকার ‘ওয্যা’ (عزى) সবচাইতে প্রসিদ্ধ।
এভাবে আস্তে আস্তে আরবের ঘরে ঘরে মূর্তির প্রচলন ঘটে। ফলে মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘বা গৃহে ৩৬০টি মূর্তি দেখতে পান এবং সবগুলোকে বের করে এনে ভেঙ্গে গুঁড়ো করে দেন ও কা‘বা গৃহ পানি দিয়ে ধুয়ে ছাফ করে ফেলেন।
বিদ‘আতের প্রচলন :
মূর্তিপূজা করা সত্ত্বেও তারা ধারণা করত যে, তারা দ্বীনে ইবরাহীমের উপরে দৃঢ়ভাবে কায়েম আছে। কেননা আমর বিন লুহাই তাদের বুঝিয়েছিল যে, এগুলি ইবরাহীমী দ্বীনের বিকৃতি নয়, বরং ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’। অর্থাৎ ভালো কিছুর সংযোজন মাত্র। এজন্য সে বেশকিছু ধর্মীয় রীতি-পদ্ধতি আবিষ্কার ও চালু করেছিল। যেমন- (১) তারা মূর্তির পাশে বসে তাকে উচ্চকণ্ঠে আহবান করত ও তাদের অভাব মোচনের জন্য অনুনয়-বিনয় করে প্রার্থনা জানাতো। তারা ধারণা করত যে, এই মূর্তি তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যশীল করবে (যুমার ৩৯/৩) এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকটে সুফারিশ করবে (ইউনুস ১০/১৮)।
(২) তারা মূর্তির উদ্দেশ্যে হজ্জ করত, ত্বাওয়াফ করত, তার সামনে প্রণত হ’ত ও সিজদা করত। (৩) তারা মূর্তির জন্য নযর-নেয়ায নিয়ে আসত। সেখানে মূর্তির নামে কুরবানী করত (মায়েদাহ ৫/৩)। (৪) তারা মূর্তিকে খুশী করার জন্য গবাদি পশু ও তাদের জন্য চারণক্ষেত্র মানত করত। যাদেরকে কেউ ব্যবহার করতে পারত না (আন‘আম ৬/১৩৮-১৪০)। (৫) তারা তাদের বিভিন্ন কাজের ভাল-মন্দ ফলাফল ও ভাগ্য নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন প্রকারের তীর ব্যবহার করত। যাতে হ্যাঁ, না, ভাল, মন্দ ইত্যাদি লেখা থাকত। হোবল দেবতার খাদেম সেগুলো একটি পাত্রের মধ্যে ফেলে অতঃপর তাতে ঝাঁকুনি দিয়ে তীরগুলি ঘুলিয়ে ফেলত। অতঃপর যে তীরটা বেরিয়ে আসত, সেটাকেই তারা ভাগ্য মনে করত এবং সে অনুযায়ী কাজ করত। (৬) এতদ্ব্যতীত তারা জ্যোতিষীদের কথার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করত এবং বিশেষ বিশেষ নক্ষত্রকে মঙ্গলামঙ্গলের কারণ মনে করত। (৭) তারা পাখি উড়িয়ে দিয়ে কাজের শুভাশুভ ও ভাল-মন্দ নির্ধারণ করত।
দ্বীনে ইবরাহীমীতে উপরোক্ত শিরক ও বিদ‘আত সমূহ চালু করার পরেও তাদের অহংকার ছিল এই যে, (১) আমরা ইবরাহীম (আঃ)-এর দ্বীনে হানীফ-এর খাঁটি অনুসারী। তাঁরা কা‘বা গৃহের সংরক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক। অতএব তাদের সমকক্ষ আরব ভূখন্ডে কেউ নেই। তাদের এই বড়ত্বের ও আভিজাত্যের অহংকার এতদূর পৌঁছে গিয়েছিল যে, তারা যেহেতু ‘হুম্স’ (حُمْس) অর্থাৎ ‘সবচেয়ে বড় বীর ও বড় ধার্মিক’ অতএব তাদের পক্ষে ‘হারাম’-এর সীমানার বাইরে কোন ‘হালাল’ এলাকায় যাওয়াটা মর্যাদাকর নয়। তারা যেহেতু ‘ক্বাত্বীন’ (قطين ) বা ‘আহ্লুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর ঘরের বাসিন্দা, সেকারণ তারা হজ্জের মওসুমে ‘মুযদালিফায়’ অবস্থান করত, যা ছিল হারাম এলাকার অভ্যন্তরে। হারামের বাইরে হওয়ার কারণে তারা আরাফাতের ময়দানে যেত না বা সেখান থেকে মক্কায় ফিরে আসা অর্থাৎ ত্বাওয়াফে এফাযাহ করত না। যা ছিল হজ্জের সবচেয়ে বড় রুকন। তারা মুযদালেফায় অবস্থান করত ও সেখান থেকে মক্কায় ফিরে আসত। সেজন্য আল্লাহ নির্দেশ দেন, ثُمَّ أَفِيْضُواْ مِنْ حَيْثُ أَفَاضَ النَّاسُ ‘অতঃপর তোমরা ঐ স্থান থেকে ফিরে এসো ত্বাওয়াফের জন্য, যেখান থেকে লোকেরা ফিরে আসে (অর্থাৎ আরাফাত থেকে) (বাক্বারাহ ২/১৯৯)।
(২) এতদ্ব্যতীত তারা নিজেরা ধর্মীয় বিধান রচনা করেছিল যে, বহিরাগত হাজীগণ মক্কায় এসে প্রথম ত্বাওয়াফের সময় তাদের পরিবেশিত ধর্মীয় কাপড় (ثياب الحُمْس) পরিধান করবে। সম্ভবতঃ এটা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থদুষ্ট বিদ‘আত ছিল। যদি কেউ (আর্থিক কারণে বা অন্য কারণে) তা সংগ্রহে ব্যর্থ হয়, তবে পুরুষেরা সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে এবং মেয়েরা সব কাপড় খুলে রেখে কেবল ছোট্ট একটা কাপড় পরে ত্বাওয়াফ করবে। এতে তাদের দেহ একপ্রকার নগ্নই থাকত। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন يَا بَنِيْ آدَمَ خُذُوْا زِيْنَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ ‘হে বনু আদম! প্রতিবার মসজিদে উপস্থিত হবার সময় তোমাদের পোষাক পরিধান কর’ (আ‘রাফ ৭/৩১)। তাদের কাছ থেকে ‘হুম্স’ কাপড় কিনতে বাধ্য করার জন্য তারা এ বিধানও করেছিল যে, যদি বহিরাগত কেউ উত্তম পোষাকে এসে ত্বাওয়াফ করে, তাহ’লে ত্বাওয়াফ শেষে তাদের ঐ পোষাক খুলে রেখে যেতে হবে। যার দ্বারা কেউ উপকৃত হ’ত না। (৩) তাদের বানানো আরেকটা বিদ‘আতী রীতি ছিল এই যে, তারা এহরাম পরিহিত অবস্থায় স্ব স্ব বাড়ীর সম্মুখ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। কিন্তু বাকী আরবরা সকলে স্ব স্ব বাড়ীর পিছন দিকের সরু পথ দিয়ে গৃহে প্রবেশ করবে। সম্মুখ দরজা দিয়ে নয়। এভাবে তারা তাদের ধার্মিকতার ক্ষেত্রে বৈষম্যগত শ্রেষ্ঠত্বের গৌরব সারা আরবের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, وَلَيْسَ الْبِرُّ بِأَنْ تَأْتُوْا الْبُيُوْتَ مِنْ ظُهُوْرِهَا وَلَـكِنَّ الْبِرَّ مَنِ اتَّقَى وَأْتُواْ الْبُيُوْتَ مِنْ أَبْوَابِهَا ‘আর পিছনের দিক দিয়ে ঘরে প্রবেশ করার মধ্যে কোন মঙ্গল নেই। বরং মঙ্গল রয়েছে আল্লাহকে ভয় করার মধ্যে। তোমরা ঘরে প্রবেশ কর সম্মুখ দরজা দিয়ে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৯)।
উপরোক্ত আলোচনায় তৎকালীন আরবের ও বিশেষ করে মক্কাবাসীদের মধ্যে প্রচলিত শিরক ও বিদ‘আত সমূহের একটা চিত্র পাওয়া গেল। যা তারা ইবরাহীমের একত্ববাদী দ্বীনে হানীফের মধ্যে ধর্মের নামে তারা চালু করেছিল।
ইয়াছরিবের ইহুদী-নাছারাদের অবস্থা :
অপর পক্ষে যারা ইহুদী-নাছারা ছিল, যারা প্রধানতঃ ইয়াছরিবে (মদীনায়) বসবাস করত, যারা অত্যাচারী রাজা বখত নছর কর্তৃক কেন‘আন (ফিলিস্তীন) থেকে উৎখাত হওয়ার পরে ইয়াছরিবে এসে বসবাস শুরু করেছিল এই উদ্দেশ্যে যে, তারা বায়তুল মুক্কাদ্দাস হারিয়েছে। অতএব তারা এখন বায়তুল্লাহর নিকটবর্তী থাকবে এবং নিয়মিত হজ্জ-ওমরাহর মাধ্যমে পরকালীন পাথেয় হাছিল করবে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল যে, আখেরী নবীর আবির্ভাব যেহেতু মক্কায় হবে এবং তার আবির্ভাবের সময় আসন্ন, অতএব তারা দ্রুত তার দ্বীন কবুল করবে এবং তার নেতৃত্বে আবার বায়তুল মুক্বাদ্দাস দখল করবে। তবে তাদের ধারণা ছিল এই যে, আখেরী নবী অবশ্যই তাদের বংশ থেকেই হবেন। কিন্তু তা না হওয়াতেই হ’ল যত বিপত্তি। তাদের মধ্যে তাওরাত-ইঞ্জীলের কোন শিক্ষা অবশিষ্ট ছিল না। তাদের ধর্ম ও সমাজ নেতারা (الأحبار والرهبان) ভক্তদের কাছে ‘রব’-এর আসন দখল করেছিল। ইহুদীরা ওযায়েরকে আল্লাহর বেটা বানিয়েছিল এবং নাছারারা মসীহ ঈসাকে একইভাবে দাবী করেছিল (তওবাহ ৯/৩০-৩১)। বরং তারা মারিয়াম, ঈসা ও আল্লাহকে নিয়ে তিন উপাস্যের সমন্বয়ে ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল (মায়েদাহ ৫/৭৩)। তাদের পীর-দরবেশরা বাতিল পন্থায় ধর্মের নামে মানুষের অর্থ-সম্পদ লুট করত এবং তাদেরকে আল্লাহর পথ হতে ফিরিয়ে রাখতো (তওবাহ ৯/৩৪)। আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তারা তা হারাম করত না (তওবাহ ৯/২৯)। এক কথায় তাওরাত-ইঞ্জীলের বাহক হবার দাবীদার হ’লেও তারা ছিল পূরা স্বেচ্ছাচারী দুনিয়াদার।
আরবের সামাজিক অবস্থা :
(ক) নারীদের অবস্থা : তৎকালীন আরবে বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজন বসবাস করত। সেখানকার অভিজাত শ্রেণীর লোকদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে খুবই উন্নত ছিল। পুরুষ প্রধান সমাজ ব্যবস্থা থাকলেও নারীদের ছিল মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান। পরিবারে পুরুষ ও মহিলাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল মর্যাদা ও ন্যায় ভিত্তিক ব্যবস্থার উপরে প্রতিষ্ঠিত। বহু ব্যাপারে মহিলাদের স্বাধীনতা দেওয়া হ’ত। তাদের যুক্তি সংগত কথাবার্তার যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হ’ত। অভিজাত পরিবারের মহিলাদের রক্ষণাবেক্ষণ ও তাদের মান-সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা হ’ত। তাদের মর্যাদা হানিকর কোন অবস্থার উদ্ভব ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে তরবারি কোষমুক্ত হয়ে যেত। মহিলাদের মর্যাদা এতই উঁচুতে ছিল যে, বিবদমান গোত্রগুলিকে একত্রিত করে সন্ধিচুক্তি সম্পাদনেও তারা সক্ষম হ’ত। পক্ষান্তরে তাদের উত্তেজিত বক্তব্যে ও কাব্য গাথায় যেকোন সময় দুই গোত্রে যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারত। ওহোদের যুদ্ধে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা তার সাথী মহিলাদের নিয়ে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে একাজটিই করেছিল। তাদের মধ্যে বিবাহ পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত উঁচু মানের। উভয় পক্ষের অভিভাবকগণের সম্মতি ও কনের স্বীকৃতি লাভের পর বর কনেকে নির্ধারিত মোহরানার বিনিময়ে বিয়ে করতে পারত। বিয়েতে ও সন্তানের আক্বীক্বাতে সমাজ নেতাদের দাওয়াত করে ধুমধামের সাথে অনুষ্ঠান করা তাদের সামাজিক রেওয়াজ ছিল।
অপর পক্ষে সাধারণ ও দরিদ্র শ্রেণীর আরবদের মধ্যে ছিল এর বিপরীত চিত্র। তাদের মধ্যে চার ধরনের বিবাহ চালু ছিল। এক ধরনের ছিল অভিজাত শ্রেণীর মত পারস্পরিক সম্মতি ও মোহরানার বিনিময়ে বিবাহ পদ্ধতি। কিন্তু বাকী তিনটি পদ্ধতিকে বিবাহ না বলে স্পষ্ট ব্যভিচার বলা উচিত। যা ভারতীয় হিন্দু সমাজে রাক্ষস বিবাহ, গান্ধর্ব্য বিবাহ ইত্যাদি নামে আধুনিক যুগেও চালু আছে বলে জানা যায়। আরবীয় সমাজে স্বাধীনা ও দাসী দু’ধরনের নারীর অস্তিত্ব ছিল। দাসীদের অবস্থা ছিল মানবেতর। তারা বাজার-ঘাটে বিক্রয় হ’ত। মনিবের মনোরঞ্জনই ছিল তাদের প্রধান কাজ। স্বাধীনাগণ সমাজে সম্মানিতা হিসাবে গণ্য হতেন।
(খ) গোত্রীয় সমাজ ব্যবস্থা : আরবদের সামাজিক ব্যবস্থা গোত্র প্রধান হওয়ার কারণে বংশীয় ও আত্মীয়তার সম্পর্ককে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হ’ত। মারামারি ও হানাহানিতে জর্জরিত উক্ত সমাজে কেবল গোত্রীয় ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধনের উপরে নির্ভর করেই তাদের টিকে থাকতে হ’ত। ন্যায়-অন্যায় সবকিছু নির্ণীত হ’ত গোত্রীয় স্বার্থের নিরিখে। আজকালকের কথিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থায় যে উৎকট দলতন্ত্র আমরা লক্ষ্য করছি, তা জাহেলী আরবের গোত্রীয় সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে অনেকটা তুলনীয়। বরং তাদের চাইতে নিম্নতর অবস্থার দিকে আমরা ধাবিত হচ্ছি। কেননা তখনকার যুগের ক্ষয়-ক্ষতির চাইতে আজকের যান্ত্রিক যুগের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ অকল্পনীয়ভাবে বেশী। গোত্র সমূহের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে থাকত। সেকারণ তারা অধিক সংখ্যায় পুত্র সন্তান কামনা করত। অধিক সংখ্যক ভাই ও পুত্র সন্তানের মালিককে সবাই সমীহ করত। যুদ্ধে পরাজিত হ’লে নারীদের বেইযযতি ও তাদের লুট করে নিয়ে যাওয়ার ভয়ে অথবা দরিদ্রতার কারণে অনেকে কন্যা সন্তানকে শিশুকালেই হত্যা করে ফেলত। তাদের কোন গোত্রীয় আর্থিক রিজার্ভ ছিল না। যুদ্ধ শুরু হ’লে সবাই প্রয়োজনীয় ফান্ড গোত্র নেতার কাছে জমা করত ও তা দিয়ে যুদ্ধের খরচ মেটাত। তবে পূর্ব থেকে ধর্মীয় রীতি চলে আসার কারণে তারা বছরে চারটি সম্মানিত মাসে (যুল-ক্বা‘দাহ, যুলহিজ্জাহ, মুহাররম ও রজব) যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ রাখতো। এটা ছিল তাদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি ধর্মীয় রক্ষাকবচ। গোত্রনেতারা একত্রে বসে সামাজিক শান্তি-শৃংখলা রক্ষা করা, কোন গোত্রের সাথে যুদ্ধ শুরু বা শেষ করা কিংবা সন্ধিচুক্তি করা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করত। মক্কায় ‘দারুন নাদওয়া’ ছিল এজন্য বিখ্যাত।[1] তাদের মধ্যে মদ্যপানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। যুদ্ধ ও পেশীশক্তিই বিজয় লাভের মানদন্ড ছিল। আরবের সামাজিক অবস্থাকে এক কথায় বলতে গেলে গরমযঃ রং জরমযঃ তথা ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে পরিচালিত হ’ত। আজকের বিশ্ব ব্যবস্থা তার চাইতে মোটেই উন্নত নয়।
অর্থনৈতিক অবস্থা : ব্যবসা ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন। ত্বায়েফ, সিরিয়া, ইয়ামন প্রভৃতি উর্বর এলাকা ছাড়াও অন্যত্র পশু-পালন জনগণের অন্যতম প্রধান অবলম্বন ছিল। উট ছিল বিশেষ করে দূরপাল্লার সফরের জন্য একমাত্র স্থল পরিবহন। গাধা, খচ্চর মূলতঃ স্থানীয় পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হ’ত। মক্কার ব্যবসায়ীগণ শীতকালে ইয়ামনে ও গ্রীষ্মকালে সিরিয়ায় দূরপাল্লার ব্যবসায়িক সফর করত। আর্থিক লেনদেনে সূদের প্রচলন ছিল। তারা চক্রবৃদ্ধি হারে পরস্পরকে সূদভিত্তিক ঋণ দিত। রাস্তা-ঘাটে প্রায়ই ব্যবসায়িক কাফেলা লুট হ’ত। সেজন্য সশস্ত্র যোদ্ধাদল নিয়ে ব্যবসায়ী কাফেলা রওয়ানা হ’ত। তবে কা‘বা গৃহের খাদেম হওয়ার সুবাদে মক্কার ব্যবসায়িক কাফেলা বিশেষভাবে মর্যাদামন্ডিত ছিল এবং সর্বত্র নিরাপদ থাকত। বছরের আট মাসে লুটতরাজের ভয় থাকলেও বাকী চারমাসে তারা নিশ্চিন্তে ব্যবসা করত। এই সময় ওকাযের মেলা ছাড়াও আরবের বিভিন্ন প্রান্তে আরও অনেকগুলি বড় বড় মেলা বসত। এইসব বাণিজ্য মেলায় প্রচুর বেচাকেনার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা লাভবান হ’ত। তাদের মধ্যে বস্ত্র, চর্ম ও ধাতব শিল্পের প্রচলন ছিল। ইয়ামন, হীরা ও সিরিয়া প্রভৃতি অঞ্চল এইসব শিল্পে সমৃদ্ধ ছিল। তবে গৃহের আঙিনায় বসে সূতা কাটার কাজে অধিকাংশ আরব মহিলাকে নিয়োজিত দেখা যেত। কোন কোন এলাকায় কৃষিকাজ হ’ত। ছোলা, ভুট্টা, যব ও আঙ্গুরের চাষ হ’ত। মক্কা-মদীনায় গমের আবাদ ছিল না। আমীর মু‘আবিয়ার খেলাফতকালে প্রথম সিরিয়া থেকে মদীনায় গম রফতানী করা হয়। খেজুর বাগান ব্যাপক হারে দেখা যেত। খেজুর ছিল তাদের অন্যতম প্রধান উপজীবিকা।
তাদের কোন গোত্রীয় অর্থনৈতিক ফান্ড ছিল না। সেকারণ সমাজের লোকদের দারিদ্র্য ও রোগ-ব্যধি দূরীকরণে ও স্বাস্থ্য সেবার কোন সমন্বিত কর্মসূচী ও কর্মপরিকল্পনা ছিল না। পারস্পরিক দান ও বদান্যতার উপরেই তাদের নির্ভর করতে হ’ত। নিখাদ পুঁজিবাদী অর্থনীতি চালু ছিল। যার ফলে সমাজে একদল উচ্চবিত্ত থাকলেও অধিকাংশ লোক বিত্তহীন ও মানবেতর জীবন যাপন করত। সাধারণ অবস্থা ছিল এই যে, আরবদের সহায়-সম্পদ তাদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যয়িত না হয়ে সিংহভাগই ব্যয়িত হ’ত যুদ্ধ-বিগ্রহের পিছনে। ফলে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। আজকের বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এর চেয়ে মোটেই উন্নত নয়। আরবীয় সমাজে উচ্চবিত্ত লোকদের মধ্যে মদ-জুয়া ইত্যাদির ব্যাপক প্রচলন ছিল। সেখানে বিত্তহীনরা দাস ও দাসীরূপে বিক্রয় হ’ত ও মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হ’ত।
নৈতিক অবস্থা :
উদার মরুচারী আরবদের মধ্যে নৈতিকতার ক্ষেত্রে দ্বিমুখী ধারা পরিলক্ষিত হ’ত। একদিকে যেমন তাদের মধ্যে মদ্যপান, ব্যভিচার, মারামারি-হানাহানি লেগে থাকত। অন্যদিকে তেমনি দয়া, উদারতা, সততা, পৌরুষ, সৎসাহস, ব্যক্তিত্ববোধ, সরলতা ও অনাড়ম্বরতা, দানশীলতা, আমানতদারী, মেহমানদারী, প্রতিজ্ঞা পরায়ণতা ইত্যাদি সদগুণাবলীর সমাবেশ দেখা যেত। তাদের কাব্য প্রিয়তা এবং উন্নত কাব্যালংকারের কাছে আধুনিক যুগের আরবী কবি-সাহিত্যিকরা কিছুই নয়। তাদের স্মৃতিশক্তি এত প্রখর ছিল যে, একবার শুনলেই হুবহু মুখস্থ বলে দিত। বড় বড় ক্বাছীদা ও দীর্ঘ কবিতাগুলি তাদের মুখে মুখেই চালু ছিল। লেখাকে এজন্য তারা নিজেদের জন্য হীনকর মনে করত। দুর্বল স্মৃতির কারণে আজকের বিশ্ব লেখাকেই অধিক গুরুত্ব দেয়। অথচ লেখায় ভুল হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তৎকালীন আরবদের স্মৃতিতে ভুল কদাচিৎ হ’ত। সম্ভবতঃ এই সব সদ গুণাবলীর কারণেই বিশ্বনবীকে আল্লাহ বিশ্বকেন্দ্র মক্কাতেই প্রেরণ করেন। যাদের প্রখর স্মৃতিতে কুরআন ও হাদীছ অবিকৃত অবস্থায় নিরাপদ থাকে এবং পরবর্তীতে তা লিখিত আকারে সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়। যদিও কুরআন ও হাদীছ লিখিত ভাবেও তখন সংকলিত হয়েছিল।
উপসংহার
উপরের আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল আরব ভূখন্ডের মরুচারী মানুষেরা বিভিন্ন মানবিক দুর্বলতার অধিকারী হ’লেও তাদের মধ্যে উন্নত মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঈর্ষণীয়ভাবে পরিদৃষ্ট হ’ত। আদি পিতা-মাতা আদম ও হাওয়ার অবতরণ স্থল হওয়ার কারণে এই ভূখন্ড থেকেই মানব সভ্যতা ক্রমে পৃথিবীর অন্যান্য ভূখন্ডে বিস্তার লাভ করেছে। এই ভূখন্ডে আরাফাত-এর না‘মান উপত্যকায় সৃষ্টির সূচনায় আল্লাহ পাক সমস্ত মানবকূলের নিকট হ’তে তাঁর প্রভুত্বের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন (আ‘রাফ ৭/১৭২-১৭৩)। একই সাথে তিনি সকল নবীর কাছ থেকে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপরে ঈমান আনা ও তাঁকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতার অঙ্গীকার নেন (আলে ইমরান ৩/৮১)।
এই ভূখন্ডেই হাযার হাযার নবী ও রাসূলের আগমন ঘটেছে। এই ভূখন্ডেই আল্লাহর ঘর কা‘বাগৃহ অবস্থিত। এই ভূখন্ড বাণিজ্যিক কারণে সারা বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। জান্নাতের ভাষা আরবী এই ভূখন্ডের কথিত ও প্রচলিত ভাষা ছিল। সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা, প্রখর স্মৃতিশক্তি এবং সততা ও আমানতদারীর অনুপম গুণাবলীর প্রেক্ষাপটে আরব ভূমির কেন্দ্রবিন্দু মক্কাভূমির অভিজাত বংশ কা‘বা গৃহের তত্ত্বাবধায়ক ও রক্ষণাবেক্ষণকারীদের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটেই আল্লাহ মানবজাতির কল্যাণে প্রেরিত শ্রেষ্ঠতম নে‘মত কুরআন ও সুন্নাহর আমানত সমর্পণ করেন। ফালিল্লা-হিল হাম্দ। এক্ষণে আমরা নবীজীবনের মূল আলোচনায় অগ্রসর হব।
শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ-১:
বিশ্বনবী ও শেষনবী হবার কারণেই বিশ্বকেন্দ্র মক্কাতে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে প্রেরণ করা হয়।
সারা বিশ্বে তাওহীদের দাওয়াত দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তৎকালীন বিশ্বের সেরা বাণিজ্য কেন্দ্র ও যোগাযোগ কেন্দ্র আরব ভূখন্ডে শেষনবী প্রেরিত হন।
তাওরাত-ইঞ্জীল হিব্রু ভাষায় নাযিল হয়। কিন্তু কুরআন নাযিল হয়েছে জান্নাতী ভাষা আরবীতে। তাই আল্লাহর ঘরের তত্ত্বাবধায়ক শুদ্ধভাষী আরব তথা কুরায়েশ বংশে শেষনবীর আগমন ঘটে।
আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র সে যুগে ছিল না। তাই প্রখর স্মৃতিধর আরবদের নিকটেই কুরআন ও সুন্নাহর অমূল্য নে‘মত সংরক্ষণের আমানত সমর্পণ করা হয়।
আরবরা ছিল আজন্ম স্বাধীন ও বীরের জাতি। তাই তৎকালীন রোমক ও পারসিক পরাশক্তির মুকাবিলায় ইসলামী খেলাফতের বাস্তবায়নের জন্য শেষনবীর আগমন স্থল ও কর্মস্থল হিসাবে আরব ভূখন্ডকে নির্বাচন করা হয়।
পরবর্তী অংশ পড়ুন: মুহাম্মাদ (ছাঃ) -এর জন্ম ও বংশ পরিচয়
[1] ‘দারুন নাদওয়া’ ছিল মসজিদে হারাম সংলগ্ন কুছাই বিন কেলাবের বাড়ী। ইসলামী যুগে এটি মসজিদুল হারামের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
2 responses to “হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) এর জীবনী পর্ব ১ – তৎকালীন আরবের অবস্থা”
[…] পূর্বের অংশ পড়ুন: হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) এর জীবনী পর্ব ১ – ত… […]
thanks sir very helpful articles
Bangla Hadis